X

অবশেষে আবিষ্কার হলো ক্যান্সারের ঔষধ, সত্যি কি তাই? || ডা. মোঃ মারুফুর রহমান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন, ২০২২, বৃহস্পতিবার

ডা. মোঃ মারুফুর রহমান
চিকিৎসক ও পিএইচডি গবেষক
ডিপার্টমেন্ট অফ অনকোলজি এন্ড মেটাবলিজম
ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য।

ছবিঃ ডা. মোঃ মারুফুর রহমান।

গত কয়েকদিন ধরে নিউজফিডে ক্যান্সার চিকিৎসায় এক জাদুকরি ম্যাজিক বুলেট ধরনের ওষুধের অবিশ্বাস্য ফলাফলের খবর দেখতে পাচ্ছি। গবেষণার ক্ষেত্রে স্কেপ্টিসিজম বা সন্দেহবাদীতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে যখন অপ্রাত্যাশিত কোন দাবি করা হয়। সে কারনেই মূল গবেষণা প্রবন্ধটি পুরোটা পড়লাম (শুধু এবস্ট্র‍্যাক্ট নয়)। ফলাফল সম্পর্কে বলার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য দেই।

ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটা অন্যান্য অধিকাংশ রোগের মত সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন না। এ বিষয়ে এই টেড-এড ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ

https://youtu.be/h2rR77VsF5c

তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেহের প্রায় যেকোন সুস্থ কোষই ক্যান্সার কোষে পরিনত হতে পারে। সুস্থ কোষের ক্যান্সার কোষে পরিনত হবার অর্থ হচ্ছে আমাদের নিজেদের দেহ কোষেরই আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মত পরিস্থিতি। সে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে, আশেপাশে স্বাভাবিক কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, নিজে সব পুষ্টি টেনে নিতে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করতে থাকে বহিরাগত জীবাণুর মত। প্রতিবার বংশবৃদ্ধির সময় আরও পরিবর্তিত হয়ে সে আলাদা ধরনের আরও শক্তিশালী ক্যান্সার কোষ জন্ম দিতে থাকে (Clonal Expansion)। যেমন এক গ্লিওব্লাস্টোমা (মস্তিষ্কের এক ধরনের ক্যান্সার) তেই ৬ ধরনের ক্লোন পাওয়া যায় যার কোনটা এই ওষুধে সংবেদনশীল তো কোনটা অন্য ওষুধে।

সমস্যা হলো, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহিরাগত জীবাণু চিনতে পারে কিন্তু নিজ দেহকোষ যেখানে বিদ্রোহ করেছে সেখানে তাদের বহিরাগত বলে সনাক্ত করা কঠিন। অনেক ক্যান্সার কোষই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাকি দিতে স্বাভাবিক কোষের মত “ডোন্ট কিল মি” ধরনের সিগন্যাল দেয়। যে ওষুধটি নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে সেটি একটি ইমিউনোথেরাপি ড্রাগ, Dostarlimab। এটি ক্যান্সার ও ইমিউন সেল এর মাঝের ডোন্ট কিল মি সিগনাল (PD-1 Blockade) কেটে দেয়। ফলে ইমিউন সেল ক্যান্সার কোষ চিনতে পারে এবং মেরে ফেলতে পারে।

এ ধরনের ওষুধ পৃথিবীতে নতুন না এমনকি Dostarlimab ও নতুন না। এই ওষুধগুলো সাধারনত মেটাস্ট্যাটিক (ছড়িয়ে পড়া) ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এবং ৩০-৫০% পর্যন্ত রেসপন্স (5 year survival) পাওয়া যায়। নতুন গবেষণায় ওষুধটি Stage 2/3 রেক্টাল ক্যান্সার (মলদ্বারের ক্যান্সার) এর একটা ধরন (মিস-ম্যাচ রিপেয়ার ডেফিশিয়েন্ট, মলদ্বারের ক্যান্সারের ৫-১০% এই ধরনের) এর উপর ব্যবহার করা হয়েছে।

মাত্র ১২ জন রোগীর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সময়ে এই রোগীদের ট্রিটমেন্ট হতো নিওএডজুভেন্ট কেমোরেডিওথেরাপি এবং সার্জারি যেটা তাদের আরও অজস্র শারিরীক সমস্যা তৈরি করতো। গবেষকেরা চিন্তা করলেন যেহেতু ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারে এই ইমিউনোথেরাপির কার্যকারিতা (লং টার্ম সার্ভাইভাল) ৩৩-৫৫% তাই ছড়িয়ে না পড়া বা স্থানীয়ভাবে ছড়ানো (অর্থাৎ আক্রান্ত অঙ্গের আশেপাশেই) ক্যান্সারে এটি হয়তো আরও ভালো কাজ করতে পারে। এই থিওরি থেকে তারা একটি সিংগেল গ্রুপ নন র‍্যান্ডমাইজড ফেজ টু ট্রায়াল চালান ১৬ জন রোগীর উপর। দেখা যায় এদের মাঝে ১২ জন ৬ মাস ওষুধটি পেয়েছেন এবং ১ বছর পর্যন্ত ফলোআপে তারা সুস্থ আছেন। ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণে ক্যান্সার পাওয়া যায় নি এবং যেহেতু কোন সার্জারি হয়নি তাই প্যাথোলজিক্যাল রেমিশন (সার্জিক্যাল স্যাম্পলে ক্যান্সার কোষের অনুপস্থিতি) হয়েছে কিনা জানা যায় নি।

এটা নিঃসন্দেহে দারুন খবর। কিন্তু কোন অর্থে, কাদের জন্য সেটা বোঝার ব্যাপার আছে। গবেষকগণ নিজেরাই বলেছেন এই গবেষণাটি খুব ছোট পরিসরে এবং একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে করা। এই ফলাফল অবশ্যই আরও বড় পরিসরে বিভিন্ন জাতির মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করে নিশ্চিত করতে হবে। তারা আরও বলেছেন ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের তুলনায় তাদের গবেষণায় ব্যবহৃত ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধটি কাজ করার একটি কারন হতে পারে গাট মাইক্রোবায়োম অর্থাৎ আমাদের পেটে যেসব উপকারী জীবাণুর বসবাস তাদের নির্দিষ্ট ধরনের উপস্থিতি যেটা ছড়িয়ে পড়া মলদ্বার ক্যান্সারে ভিন্ন হতে পারে।

ক্যান্সার চিকিৎসায় রেমিশন আর কিওর এক কথা না। কিউর বা নিরাময় এর অর্থ হলো রোগটির আর উপস্থিতি পাওয়া যায় নি এবং এটি আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ক্যান্সারে কিওর বলা যায়না সহজে, রেমিশন বলা হয় কারন শরীরের কোথাও যদি আণুবীক্ষণিক মাত্রার ক্যান্সার কোষ (ক্যান্সার স্টেম সেল থিওরি) থেকে যায় যেটি এইসব চিকিৎসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম, তাহলে আবার সে ফিরে আসবে এবং এই চিকিৎসা আর কাজ করবে না। এমন ঘটনা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অহরহই ঘটে তাই চিকিৎসার ফলাফল হিসাব করা হয় 3 year survival, 5 year survival, 10 year survival ইত্যাদি প্যারামিটারে।

তাই উল্লেখিত গবেষণার ভিত্তিতে ক্যান্সারকে পরাজিত করলো বিজ্ঞান এই ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন মার্কা শিরোনামের খবরে বিভ্রান্ত হবেন না। মানুষ আশায় বাচে কিন্তু ক্যান্সারে মরে। অবাস্তব আশা করা অনুচিত। অতি আশা অনেক সময় বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা নস্ট করে দেয়। যেমন করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিলো এটি ইনফেকশন আটকাতে এত শতাংশ কার্যকর। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল রিইনফেকশন হচ্ছে নানা ধরনের ভ্যারিয়েন্ট এর কারনে। তাই ভ্যাকসিনে মানুষের আস্থা কমে গেল, অনেকে ভ্যাকসিন নেয়া থেকে বিরত থাকলো। অথচ ভ্যাকসিন ঠিকই মারাত্নক রোগ ও মৃত্যু হার কমিয়েছে। সায়েন্স কমিউনিকেশন তাই বুঝে শুনে করা উচিত এবং যে কারও নয়। কোন সাংবাদিক যদি করেন অবশ্যই তার এ বিষয়ে একাডেমিক ও প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত এবং কোন প্রফেশনাল যদি করেন তাহলে অবশ্যই তার কমিউনিকেশন ও রিসার্চ ইথিক্সের প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত। ফেসবুকে ভাইরাল হবার জন্য দয়া করে ভাইরাল শিরোনামে অবাস্তব প্রত্যাশা বা হতাশা কোনটাই ছড়াবেন না।

মূল গবেষণা প্রবন্ধটির লিংকঃ
https://www.nejm.org/doi/pdf/10.1056/NEJMoa2201445
(পূর্ণাঙ্গ আর্টিকেল পেতে একাউন্ট খোলা লাগবে)

Sadia Kabir:
Related Post