X

দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-৯

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ১৩ আগষ্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান

সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় শব্দটা শুনলেই কেমন বুক হিম হয়ে আসে। মনে পরে যায় ১৯৯১ সালের চট্টগ্রামের সেই প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের কথা। ১০ নম্বর বিপদসংকেতের পর সেই ভয়ানক রাত, প্রাণহানি আর অনেকের সব হারানোর কথা। ক্লাস ফোরে পড়তাম, কিন্তু এখনো ভুলিনি সে সময়কার কথা।

ওমানী স্টাফ বললো ঘূর্ণিঝড়ের নাম “শাবালা”, আমি ভাবলাম কি আজব নাম! পরে বাকিদের কথায় বুঝলাম, নামটি আসলে “চপলা”। ভারতীয়-পাকিস্তানীরা বলছে “চাপালা”, ভাষায় ‘চ’ আর ‘প’ বর্ণ না থাকায় আরবরা তাকে “শাবালা” বলছে। নামটা বাংলাদেশের দেয়া। আরও জানলাম, উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় গুলোর আগে থেকেই নামকরণ করা থাকে, বিভিন্ন দেশের প্রস্তাবিত, একবার মেয়েলী নাম, পরের বার পুরুষ নাম। যেমন চপলার পরের নাম “মেঘ”।

দেখলাম তাদের দুর্যোগ পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনা। সেনাবাহিনী নামলো, ব্যাপক প্রচারণা চালানো হল, পাহাড়ি বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে শেল্টারে আনা হলো, জেলে যাদের বেশিরভাগ আবার বাংগালী, তাদের সতর্ক করা হলো সমুদ্র থেকে দূরে থাকতে। হাসপাতাল থেকে নিতান্ত জরুরী রোগী ছাড়া সবাইকে ছুটি দেয়া হলো। স্বাভাবিক রোস্টার চেঞ্জ করে জরুরী রোস্টার করে সবাইকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। যে কোন কারণে যদি জলোচ্ছ্বাস হয়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে আর একাধিক দিনও হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত চপলা ভয়াবহ ভাবে আঘাত হানলো প্রতিবেশী যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ ইয়েমেনে, সালালাহতে মোড় নিতে নিতে দূর্বল হয়ে আসলো। প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি উঠলো, সমুদ্র উত্তাল হলো কিন্তু ভয়াবহ কোন ক্ষতি হলনা। এর ঠিক তিন বছর পর, আরেক ঘূর্ণিঝড় “মেকুনু” তে সালালাহ তছনছ হয়েছিলো, খবরে আর সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি। তবে প্রকৃতিকে দিয়ে গেছে নতুন জলপ্রপাত আর ঝর্ণা, মুগ্ধ হয়ে তার ছবি দেখেছি।

দেশের বাইরে এসে যখনই ভালো কিছু দেখেছি, মনে মনে দেশের কথা সবসময়ই মনে হয়েছে। রাস্তাঘাট, প্রকৃতি, বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা দেখে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। আমাদের সবই আছে বা ছিলো, আমরা নিজের হাতে দুমরে মুচরে ফেলেছি, ফেলছি।

বাংলাদেশ আর ওমানের শুরুটা প্রায় একই সময়ে। বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে আর ওমানের পুনর্জন্ম হয় ১৯৭০ সালে, যখন সুলতান কাবুস তার অত্যাচারী ও দুশ্চরিত্র বাবাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। একজন শাসককে তার জনগণ কি তীব্র ভালবাসতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করতামনা। সুলতানের নিজের কোন সন্তান নেই, দেশে ছোটবড় সবার কাছে তিনি “বাবা কাবুস”। কেনই বা ভালবাসবেনা, আধুনিক ওমানের সবকিছুই তার অবদান। কারো সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই। প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেন কে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ কোণঠাসা করেছে, ওমান বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। ইয়েমেন বর্ডার থাকায় আমরা সবসময়ই ইয়েমেনী রোগী পেতাম, বেশিরভাগই অপুষ্টি আর চিকিৎসার অভাবে রোগ-শোকে ভোগা। আমাদের উপর নির্দেশ ছিলো ইয়েমেন থেকে আসা রোগীদের ওমানী রোগীদের মতই বিবেচনা করতে, ফ্রী চিকিৎসা পেত তারাও। সুলতান যখন মারা যান, আমি অনুভব করেছি তাদের কষ্ট, তারা খুব আপন কাউকে হারিয়েছে।

মাত্র ৩০ বছর আগে নাকি ওমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে তেমন কিছু ছিলনা, এখনো তাদের মূল চালিকাশক্তি বিদেশি ডাক্তার। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে, করছে। একারণেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য কিছু দেশের তুলনায় আয় কম হলেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওমান সেরা আর বিশ্ব তালিকায় সপ্তম। যদিও উচ্চতর  চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিদেশের উপর নির্ভরশীল। গুটিকয়েক মেডিক্যাল কলেজ আর একটি মাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেধাবী ডাক্তারদের সরকারি খরচে উন্নত দেশে পাঠানো হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণের  জন্য, শর্ত থাকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসতে হবে।

নিজ দেশে যখন ফিরে তাকাই, দেখতে পাই সম্ভাবনায় ভরপুর একটি দেশকে কিভাবে নষ্টরা লুটেপুটে খাচ্ছে। একসময় আমি ভাবতাম আমাদের টাকার অভাব, তাই উন্নত দেশের মত আমরা কিভাবে ভাবতে পারি! কিন্তু যখন শুনি শত কোটি টাকা নিয়ে দুর্জনেরা দেশ ছাড়ছে, লক্ষ লক্ষ টাকায় জানালার পর্দা, বালিশ, নারকেল গাছ কেনা হয়, কোন সন্দেহই থাকেনা, সম্পদের অভাব হয়তো আমাদের আছে, কিন্তু যতটুকুই আছে দূর্নীতির ঘুণপোকারা সব নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

২০১৬ তে আমরা অবশেষে ওমান ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই, যদিও দ্বিধা পিছু ছাড়েনা। নতুন যেখানে যাবো, এখানকার মতো বন্ধু কি পাবো? এমন দিনগুলো যেখানে সন্ধ্যা শুরু হয় রাতে, রাত দু’টায় হঠাৎ শখ হয় শর্মা আর মশলা চায়ের, আর যা ভাবা তাই কাজ, বন্ধুরা মিলে লাগাও ছুট। বাসার পাশে সুলতান কাবুস মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সুর কিংবা মেয়ের বন্ধুদের কলকাকলি। সেই রাস্তা ধরে ছুটে চলা, একপাশে সারি সারি  কলাগাছ আর অন্যপাশে ডাব, নারকেলের দোকান থাকায় যার নাম দিয়েছিলাম আমি “নরসিংদী রোড”। পাহাড়ের চূড়ায় রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া, যেখান থেকে শহরটাকে অসংখ্য আলোর বিন্দু মনে হয়।

ওমানের বিভিন্ন প্রান্তে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। কিন্তু আমি সালালাহ আর পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া, আর বিশেষ প্রয়োজনে মাস্কাট ছাড়া অন্য কোথাও যাইনি। তাই আমার ওমান দর্শন অনেকটা ‘অন্ধের হাতি দেখা’র মতো, অনেকের অভিজ্ঞতার সাথে নাও মিলতে পারে।

এসময় অনেকে আমাদের বোকাও বললেন, কে এমন নিশ্চিন্ত শান্তির জীবন ছেড়ে যায়। কে না জানে কানাডায় ডাক্তার হওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি! ভাবতে ভাবতে অবশেষে সেদিনটা চলেই আসলো। আমি মোটামুটি শক্ত মনের মেয়ে, কিন্তু আমিও সজল চোখে প্লেনে উঠলাম। সালালাহ ছেড়ে গন্তব্য মাস্কাট, পরদিন মাস্কাট থেকে কানাডার উদ্দেশ্যে যাত্রা।

কিন্তু আমরা যা ভালোবাসি, আসলেই কি তা পেছনে ফেলে আসতে পারি। বাংলাদেশকে কি আসলেই কখনো পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি?

“You never really leave a person or place you love. Part of them you take with you, and you leave part of yourself behind.” -Unknown author

Sarif Sahriar:
Related Post