X

তাসুকো হোনজীর নোবেল বিজয়ী গবেষনায়, বাংলাদেশী ডা. হেলেনা ইসলাম এর গল্প

হেলেনা ইসলাম,নোবেল বিজয়ী ইমিউনলজিস্ট তাসুকো হোনজো’র গবেষনায়

সম্প্রতি ঘোষণা হয়ে গেল ২০১৮ সালে চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীদের নাম । ক্যান্সারের চিকিৎসায় ইমিউনলোজির প্রয়োগের জন্য এ বছর চিকিৎসায় নোবেল পান যুক্তরাষ্ট্রের জেমস পি এলিসন ও জাপানের তাসুকো হোনজো ।
এই তাসুকো হোনজো’স গবেষনা কার্যের সাথে গত ৪ বছর ধরে যুক্ত আছে বাংলাদেশের একজন কৃতি সন্তান হেলেনা ইসলাম । এমবিবিএস পাশ করার খুব ভালোভাবেই কাজ করছিলেন নবীন চিকিৎসক হবার পরেও । চিকিৎসক হিসেবে দেশেই ছিল উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তবু গবেষনা কাজের প্রতি আগ্রহ তাকে টেনে নিয়ে গেছে জাপানে । তাও এমন একজন অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে,যাকে এখন চেনে দুনিয়ার প্রতিটা মানুষই ।


তাসুকো হোনজো’র নোবেল প্রাপ্তির পর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন হেলেনা ইসলাম। বলেছেন তাসুকো হোনজোর সম্পর্কে, বলেছেন তার অনুভূতির কথা ।

তার ভাষায়ই তুলে ধরি –
– “যদ্যপি আমার গুরু”
হ্যা কিছু লিখতে চাই।
আমার পিএইচডি প্রফেসর তাসুকো হোনজোকে নিয়ে।
এই দুঃসাহস দয়া করে ক্ষমার সৌন্দর্য মেখে পড়বেন।
আপনারা সবাই জানেন , ২০১৮ সালের চিকিৎসায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস পি এলিসন ও জাপানের তাসুকো হোনজো।

প্রফেসর তাসুকো হোনজো, হোনজো সেনসি নামে যিনি সমগ্র জাপানে সুপরিচিত। না না অত্যন্ত সুপরিচিত।
সেনসিকে নিয়ে আজ সারা জাপান যে সরব ব্যাপার তা নয়, অনেক বছর সেনসি জাপানে একজন তারকা বিজ্ঞানী।
আমি, আমরা যারা উনার দুনিয়াখ্যাত গবেষণাগারের সদস্য , বছরে এই সময়, চাতকের মত সদা অপেক্ষমান সাংবাদিক চ্যানেলওয়ালাদের দেখতাম স্যারের অফিস ঘরের বাইরে। পর পর দুইবার মূল তালিকায় থাকা স্যারের নাম শেষ পর্যন্ত নোবেল জয়ীর ঘোষণায় না আসাতে আমরা খুব হতাশ হতাম। যদিও স্যার কিংবা তাঁর সেক্রেটারীদের এই বেপারে ভালো মন্দ কোন প্রকাশ ভঙি দেখিনি , বুঝতে পারিনি।

এর শুরুটা ছিল কেমন ? কিভাবেই বা হেলেনা ইসলাম তাসুকো হোনজোর সাথে কাজ করার সুযোগ পেলেন ?
– ২০১৩ সালের অক্টোবরে আমি জাপানের ওসাকায় পা রাখি ।
এটাই আমার প্রথম জাপানে আসা। দিনাজপুরে একজন নবীন চিকিৎসক হিসেবে আমার শুরুটা বেশ ভালো আর নিজের কাজ মারাত্বক আগ্রহ নিয়ে করছিলাম।
তবুও কেন যেন হঠাৎ জাপান চলে আসলাম সব থামিয়ে।
১৫ই এপ্রিল ২০১৪ সাল, কিয়োতো ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে , এড্রেস নিয়ে , স্যারকে জানিয়েছিলাম আমার গবেষণা পরিকল্পনা। একটা কমন ইমেইল যা আমি আরো বেশ কয়েকটা ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে পাঠিয়েছিলাম।
বিকাল ৩:৩২ এ করা ইমেইলের উত্তর পাই ৫৪ মিনিট পর। স্যার আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গবেষণাগার পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানালেন ।
প্রচন্ড আনন্দে স্তব্ধ , ততক্ষনে ইউটিউব, উইকি ঘেঁটে উপলব্ধির কেবল শুরু যে উনি সাধারণ কোন প্রফেসর নন।
নাগোয়া এলাকার বড় ভাই , ডঃ শাহীন, স্যারের নাম যেই না শুনলেন , ঘন্টাখানেক শুধু বুঝিয়েছেন হোনজো সেনসি আর হোনজো সেনসির গবেষণাগারের উচ্চতা।
১৯ আর ২১ এপ্রিল স্যারের সময় আছে জানিয়ে, সেক্রেটারি আমাকে ফিরতি ইমেইল করেন।
প্রথম সাক্ষাতে ১ ঘন্টা সময় দেন স্যার , আর সবশেষে এটাও বলেন , আমি কখন থেকে কাজে যোগ দিতে পারবো, জানাতে।

১ ঘন্টায় তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ মুক্তার মত উজ্জ্বল হয়ে আমার চোখের সামনে যেন ভাসছিল এবং সেটা আজ এখনো।
আমার মত অতি সামান্য-নগন্য এক ছাত্রকে স্যার এইভাবে সময় আর সুযোগ দিয়ে দিবেন কোন দূরতম ভাবনাতেও ছিলনা।
এইতো , হয়ে গেলাম দুনিয়ার সেরা ইমিনোলোজী গবেষণাগারের এক নগন্য সদস্য। অতি অতীব সৌভাগ্যবান আমি।
হ্যা,সৌভাগ্যবান তো বটেই,কিন্তু তার কর্মদক্ষতা ও মেধাই তাকে নিয়ে গেছে সেরাদের কাতারে। তিনি সুযোগ পেয়েছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপকের অধীনে পিএইচডি করার সুযোগ ।
তাসুকো হোনজো সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন হেলেনা ইসলাম। একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কর্মক্ষেত্রে কেমন ,মানুষ হিসেবে কেমন তাও জানিয়েছেন তিনি ।


– হোনজো সেনসি সবসময় ‘সৌভাগ্য’ নিয়েই একটা কথা বলেন, যে একজন ইমিওনোলোজীস্টের ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন হতে হয়।
আমরা ইঞ্জিনিয়ার না , আমাদের পক্ষে প্রোগ্রাম করে , ডিজাইন করে কিছু করা সম্ভব না। আমরা শুধু একাগ্রতা আর অধ্যাবসার নিয়ে খুঁজে যেতে পারি। বাকিটা ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য। নোবেল প্রাপ্তির আগে বা পরে স্যার বিশেষ/সাধারন প্ৰাসংগিক যে কোন আলোচনায় এই কথাটা সবাইকে জানিয়ে দেন।
নোবেল কমিটির ফোন প্রথম রিসিভ করেন হোনজো সেনসির সবচে গুরুত্বপূর্ণ সেক্রেটারি ফুকুই সান। প্রতক্ষদর্শী যারা ছিলেন সবাই জানিয়েছেন ফুকুই সান ঝরঝর করে কান্না করছিলেন আর হোনজো সেনসি তাঁকে খুশিতে জড়িয়ে ধরেন।
হোনজো সেনসি নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ আমাদের সাথে খুব দ্রুত শেয়ার করেন এবং আমরা টিম মেম্বাররা সাথে সাথেই গ্রূপ ছবি তুলি। এই ছবি নোবেল কমিটি খুব দ্রুত টুইট করে।
হোনজো সেনসি তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে কিভাবে রেগুলার কেমন রুটিন থেকে একটুও পাল্টাননা আমি অবাক হয়ে ভাবি এবং ভাবছিই..

নোবেল প্রাপ্তি সংবাদে তিনি অনেক উৎফুল্ল হন। এইটুকুই , এর কয়েকমিনিট পর আমাদের এক সহকর্মী ছাত্র’র কাছে এই বলে ক্ষমা চান যে তিনি পরেরদিন উল্লেখিত ছাত্রের জার্নাল সেশনে যোগ দিতে পারবেন না।
আমরা সবাই ধরেই নেই যে স্যার পরেরদিন সুপার বিজি হয়ে যাবেন এবং হয়তো ল্যাবে আসবেন না, সময় দিতে পারবেন না..
স্যার যথারীতি এসেছেন। এসেই আমাদের খুব আন্দিত হয়ে জানালেন, “জানো আমি ৪০০ শুভেচ্ছা মেইল রিসিভ করেছি “, এবং নিষ্পাপ শিশুর হাঁসি।
পরদিন ৩ তারিখ , উনি ল্যাবে আসেন , গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, সাক্ষাৎকার সব সামলে আমাদেরকে পুরা দিনটাই দিয়ে দেন।
আমরা যতবার খুশি ছবি পেয়েছি, অটোগ্রাফ নিয়েছি। এক নির্মল শিশুর হাসি নিয়ে উনি ঘন্টাখানিক কোশেশ করে শ্যাম্পেনের ছিপিতে নাম সাইন করেছেন( একবার অবশ্য বলছিলেন.. কাজটা অনেক কঠিন ) শুধু আমাদের জন্য।
শেষবিকেলে সবাইকে উপহারের ফুল আর উপটৌকন ভাগ করে নিতেও বলেছেন।
তাসুকো হোনজোর তত্ত্বাবধানের তার দলের কাজ ছিল মূলত ২ ধরনেরঃ
১. “পিডি-1” [ Programmed Cell Death Protein 1 (PD-1) ]
২. “এ আই ডি” [ Activation-induced Cytidine Deaminase (AID) ]
নোবেল পেয়েছেন পিডি-১ এর আবিষ্কারের জন্য । তার এই নোবেল প্রাপ্তিতে পিডি-১ থেরাপিতে সরকার নতুন করে মনযোগ দিবেন,রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করবেন । নোবেল পাওয়ার আনন্দের সাথে তাসুকো হোনজোর আনন্দিত,আশাবাদী পিডি-১ থেরাপীর সহজলভ্যতার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হওয়ায়। কারণ বর্তমানে পিডি-১ থেরাপি খুবই ব্যয়বহুল একটি থেরাপী।
কর্মস্থলে ও মানুষ হিসেবে তাসুকো হোনজো দায়িত্বশীল,কর্মঠ ও ভালো মানুষ।

– আমাদের গবেষণাগারে মান্য ,গন্য, নগন্য সকল সদস্যের কাজের খোঁজ হোনজো সেনসি শতভাগ নিজেই রাখেন, কাজ সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা , সমালোচনা , আলোচনা খুব মনযোগি শ্রোতা হয়ে শোনেন। আর সমস্যা শেয়ার করলে অপ্রত্যাশিত সফলতা দিয়ে সমাধান ও করে দেন।
আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম জাপানের ওসাকায় ২০১৬ তে। এই সময়ে হোনজো সেনসি টানা ৬ মাস ছুটি কাটতে দেন আমাকে। আমার একমাত্র ছোট বোন যে তিন রকমের কেন্সারের সাথে টানা ২ বছর যুদ্ধ করে গত মাসে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি পর পর ২ বার লম্বা ছুটি নিয়েছি। হোনজো সেনসি আমার ছুটির কারনে যে ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে কখনোই আমাকে হীনমন্য না করে ক্রমাগত সাহস দিয়েছেন। গতমাসে আমাকে হটাৎ বলে উঠলেন, হেলেনা সান, যতবার খুশি তুমি তোমার বোনকে দেখতে বাংলাদেশ যেতে পার, আমি পারমিশন দিলাম।
এই মহামানবের চেম্বারে, যতবার হতোদ্যম , হতাশ হয়ে কথা বলতে এসেছি, ফিরেছি ঐশ্বরিক শান্তি , অসাধারণ মনোবল আর সফল হবার শক্তি নিয়ে।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক,বিজ্ঞানী তাসুকো হোনজো’র এই অবদানের পাশাপাশি আমরা একজন বাংলাদেশী হিসেবে হেলেনা ইসলামের এই গবেষনা কার্যে অবদানের জন্য গর্বিত হতেই পারি।

প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটারঃ জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর

ওয়েব টিম:
Related Post