X

ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের ক্ষত ও কর্ড ব্লাড

আকলিমা খাতুন (ছদ্মনাম) , ষাটোর্ধ্ব নারী। বহুদিন যাবৎ বহুমূত্র ( ডায়াবেটিস) রোগে ভুগছেন। রোগ যে কখনো ছেড়ে যাবে না, এই ধারণা তাঁর ছিল না। তিনি ভাবতেন যে ওষুধ পড়লেই রোগ বালাই শেষ! এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। এই ওষুধ, ঐ ওষুধ, এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার করতে করতে হতাশ। শেষে ভেষজ চিকিৎসা নেয়া শুরু করলেন। এলোপ্যাথি বাদ। কারণ, কাজ হয় না, রোগ সারে না।

এখন বেশ ভালো আছেন। নিয়ম করে খাবার, ওষুধ ইত্যাদির বালাই নেই। যেমন খুশি খাওয়া যাবে। দুই টোটকা পড়লেই ডায়াবেটিস বাপ বাপ করে পালাবে!

ঘটনা ঘটলো উল্টো। সবই ঠিক ছিল, সুগার চেক করা হয় না বেশ কিছু দিন। একদিন পায়ে কী যেন ফুটলো। খালি পায়ে কত হেঁটেছেন! এখন বুড়ো বয়সে জুতা স্যান্ডেল ভাল্লাগে না। দুই দিন পর, সেই ফুটো ক্ষত হয়ে দেখা দিলো। এর মাঝে ছিল দাওয়াত। ক্ষত ঢাকতে জুতা পরে গিয়েছিলেন। সারাদিন বেড়ানো শেষে ঘরে ফিরে দেখেন ক্ষতের অবস্থা ভয়াবহ । পুঁজ হয়ে গেছে। কী মনে করে সুগার চেক করলেন। অনেক বাড়তি। চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হলেন।
দেখেশুনে চিকিৎসক যা জানালেন তাতে আঁতকে উঠার কথা। আর একটু দেরি হলেই পায়ের আংগুল সহ কিছু অংশ কেটে ফেলে দিতে হতো। Diabetic foot ulcer হয়েছে। এখনো কিছু বিকল্প আছে। PRP দিয়ে চিকিৎসা তার অন্যতম। ডাক্তার সাহেব তাঁকে যা বললেন –

Skin বা ত্বক হচ্ছে মানব দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ, শরীরের ওজনের প্রায় ১০% skin mass দিয়ে তৈরি যা পুরো শরীরকে ঢেকে রাখে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে। আর তা হলো শরীরের প্রতিরক্ষা। নিজ থেকে ক্ষয়পূরণ এবং নতুন ভাবে তৈরি হবার ক্ষমতার কারণে এটি বাইরের নানা ঘাত প্রতিঘাত থেকে শরীর কে রক্ষা করে। এর স্বাভাবিক যে গঠন তার ব্যত্যয় ঘটলেই একে বলা হয় wound বা ক্ষত। এই ক্ষত নানান কারণে হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে ছোট খাটো ক্ষত নিজে নিজেই সেরে ওঠে। জীবাণু সংক্রমণ হলে ছোট ক্ষতও সেরে উঠতে চায় না, দিন দিন খারাপ হতে থাকে। কিছু অসংক্রামক রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, ক্ষত সারিয়ে তোলার এই সক্ষমতাকে বাধা দেয়। তখন আর ক্ষত সারে না।

wound repair অনেকগুলি জিনিসের সমষ্টি, যার মাঝে রয়েছে নানা ধরনের সেল এর মাঝে সামঞ্জস্য স্থাপন( growth factor, cytokines,chemokines) . এসবের ঘাটতির কারনে wound healing অনেক সময়ে সম্পন্ন হয়না, ফলে সৃষ্টি হয় দুর্ভোগ।
তেমনই একটি অবস্থা হল Diabetic Foot ulcer – ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের ক্ষত রোগ। অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, সঠিক পরিচর্যার অভাব, সুগার নিয়ন্ত্রণে না রাখা সহ নানা কারণে এর সৃষ্টি। পৃথিবী জুড়েই এই রোগে অনেকেই আক্রান্ত হয় এবং প্রচুর অর্থের দরকার হয়ে পড়ে এই চিকিৎসায়। অনেক সময় অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে অঙ্গহানি পর্যন্ত হতে পারে।

এ ধরণের রোগের চিকিৎসায় নানারকম পদ্ধতি আছে। ধাপে ধাপে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। একটি অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি হলো PRP (Platelet Rich Plasma) দিয়ে ক্ষত সারিয়ে তোলা। এর অনন্য উপাদান ক্ষত সারিয়ে তুলতে বিশেষ সহায়ক।
রক্তের Platelet এর মাঝে রয়েছে alpha granules যা থেকে নিঃসৃত হয় Platelet derived growth factor(PDWF), Epidermal growth factor(EDWF), Insulin like growth factor(ILGF), Keratinocyte growth factor(FGF),Fibroblast growth factor(FGF),Vascular endothelial growth factor(VEGF) সহ ইত্যাদি। এসব কারণে Platelet Rich Plasma(PRP) দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা বিশ্বে সমাদৃত।
এই PRP কিভাবে পাওয়া যায়? একটি উপায় হল রুগীর নিজের শরীরের রক্ত নিয়ে সেখান থেকে PRP তৈরি করা। আরেকটি উপায় হল আরেকজনের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে। অনেক সময়ে রুগীর রক্তশূন্যতা থাকে বিধায় রুগীর রক্ত দিয়ে গুণগত মান সম্পন্ন PRP তৈরি সম্ভব হয়না। অনেক সময় রক্ত দান করার মতো ডোনার পাওয়া যায় না।

এসব ক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে Cord Blood Platelet Gel। বাচ্চা জন্মের পর নাড়ি কেটে নাড়ি ও গর্ভফুল ফেলে দেয়া হয় – অনেকটা বর্জ্যের মতো। অথচ এই নাড়ি থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করে পরে ব্যবহার করা সম্ভব। এটিই cord blood। এ ধরনের ক্ষত চিকিৎসায় যেসব উপাদান প্রয়োজন, cord blood এ সেসব উপাদানের পরিমাণ অনেক এবং উচ্চ মান সম্পন্ন। এই Cord Blood সঠিক উপায়ে সংগ্রহ করে তা থেকে cord blood platelet gel তৈরি করা গেলে অনেক সময়ে ঘরে বসেই এটি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। গতানুগতিক চিকিৎসার চেয়ে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসায় সময় এবং খরচ কম।

রোগীর সচেতনতা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, উপযুক্ত চিকিৎসা, cord blood bank গড়ে তোলা ইত্যাদি ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া গেলে বহু রোগী এ থেকে উপকৃত হবেন।

ডা. আশরাফুল হক
ট্রান্সফিউশন মেডিসিন স্পেশালিস্ট

Mahbubul Haque:
Related Post