X

কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন এবং রক্তদান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮ মার্চ ২০২১, সোমবার

লেখাঃ ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান
অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি
পরিচালক, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার

ছবিঃ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান 

তত্ত্বীয় পটভূমিঃ
কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন গ্রহণের পর কোন মানুষ জীবন রক্ষার্থে রক্ত দান করতে পারবেন কিনা এটি যেরকমভাবে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দাবী রাখে অন্যদিকে এটি একটি সংবেদনশীল সামাজিক বিষয়ও বটে। কেননা এখানে একজন মানুষকে প্রাণে বাঁচানোর চেষ্টা আছে আবার রক্তদাতা তার নিজের উপকারের জন্য টিকা নিয়েছেন কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রার উপকার উনি পূর্ণমাত্রায় পাবেন কিনা সে ব্যপারটিও জড়িত। এই দুটি ব্যপারই হচ্ছে এই পটভূমির তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা। ভ্যাক্সিন হলো কোনো একটি জীবাণুর গাঠনিক অংশবিশেষ যা সরাসরি অথবা কৃত্রিম উপায়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বাইরে তৈরি করা হয় এবং সেটি প্রক্রিয়াজাত করে মানুষ বা প্রাণীদেহে প্রদান করা হয় যেন উক্ত জীবাণুর বিরুদ্ধে বিশেষ প্রকারের প্রতিরোধী অণু বা এন্টিবডি বা বিশেষ কোষ তৈরি হয় যা ইমিউনোকম্পিটেন্ট সেল (Immunocompetent Cell) নামে পরিচিত। এই জীবাণুকে যদি কৃত্রিম উপায়ে এর রোগ উৎপন্ন করার ক্ষমতা খর্ব করে দিয়ে তার গাঠনিক বৈশিষ্ট্য সঠিক রেখে মৃতপ্রায় অবস্থায় কোনো প্রাণিদেহের শরীরে প্রবেশ করানো হয় তবে সেটিও ভ্যাক্সিন হিসেবে গণ্য হবে। কারণ মানুষের দেহে যে প্রতিরোধী কোষ থাকে তারা মৃতপ্রায় জীবাণুকে বহিরাগত অণু হিসেবে শনাক্ত করে এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ওই অণুকে তারা প্রতিরোধী কোষের নিকট পরিচিত বা উপস্থাপন করে। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে খুব জটিল অথচ খুব সমন্বিত উপায়ে দেহে জৈবনিক প্রক্রিয়া সাধিত হয় যার মাধ্যমে ঐ অণুকে নিষিক্ত করা যায় এবং তাকে বের করে দেওয়ার জন্য আরেকটি অণু দ্বারা ঘিরে নেওয়া যায় সেরকম অণু দেহে তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় প্রতিরোধ শক্তি। এখন কেউ যদি ভ্যাক্সিন নিয়ে থাকেন বিশেষ করে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন যা মূলত দেওয়া হচ্ছে মাংসপেশিতে, সেখানে প্রতিরোধী কোষ যারা বহিরাগত এই অণু শনাক্ত করে তুলনামূলক কম সংখ্যায় থাকে। কিন্তু অন্যান্য সংযোজক কলায় এদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। জলীয় বা তরল ভ্যাক্সিন যখন ধীরে ধীরে রক্তে প্রবেশ করে তখন রক্তের বিশেষ কোষ এদেরকে বহিরাগত এন্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে এবং তারা তখন বিভিন্ন সহায়ক অণুর সহায়তায় সক্রিয় হয়ে প্রতিরোধ অণু বা এন্টিবডি বা বিশেষ প্রকারের কোষ তৈরি করতে থাকে যাদেরকে টি লিম্ফোসাইট (T Lymphocyte) বলে। ঐ কোষগুলোর পৃষ্ঠদেশে সুনির্দিষ্ট প্রতিকী অণু আছে যেমন CD4, CD8 ইত্যাদি।

ছবিঃ ভ্যাক্সিন গ্রহণ (প্রতীকী)

পরবর্তীতে এই কোষগুলো সক্রিয় হয় এমনভাবে যাতে কিছু শরীরে প্রবেশ করলে তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হবে, কিন্তু কোন রোগ উৎপন্ন হবে না। এখন এস্ট্রাজেনকা’র এক ডোজ ভ্যাক্সিনে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ভাইরাস কণা থাকে যা রক্তে সম্পূর্ণভাবে শনাক্ত বা ব্যবহৃত হতে কমপক্ষে ১০-১৪ দিনের মত সময় লাগে তারপরও সবটুকু ব্যবহৃত হবে এমন নয়। সাধারণত মানবদেহে প্রায় ৫ লিটার রক্ত প্রবাহিত হয় তার মধ্যে থেকে প্রায় আধা লিটার রক্ত কমে গেলে আপাত হিসেবে ২.৫ বিলিয়ন ভাইরাস কণা থেকে ৫ ভাগের এক ভাগ সেই পরিমাণ রক্তে চলে যায়। কিন্তু এই কণা রক্তের মাধ্যমে আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করলেও তার দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে না। কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে কমপক্ষে ২.৫ বিলিয়ন ভাইরাস কণার প্রয়োজন। কিন্তু রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে মাত্র ০.২৫ বিলিয়ন অণুজীব শরীরে প্রবেশ করতে পারে। পক্ষান্তরে রক্তদাতার শরীর থেকে ০.২৫ বিলিয়ন অণুজীব সংখ্যা কমে যেতে পারে। এরকম তত্ত্বীয় দিক বিবেচনা করলে টিকার ১ম বা ২য় ডোজ নিলে সেটির ১৪ দিনের মধ্যে রক্ত দান থেকে বিরত থাকা সমর্থনযোগ্য বলে মনে হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গবেষনা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সাধারণ মানুষের জ্ঞাতার্থে ভ্যাক্সিন গ্রহণের পরে রক্তদান সম্পর্কিত সংশয় দূর এবং নির্দেশনাসমূহ প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা যায় এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তি দূর হবে এবং তারা সঠিক তথ্যগুলো জানতে পারবেন।

ছবিঃ রক্তদান (প্রতীকী)

কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করলে কি রক্ত বা প্ল্যাটিলেট দেওয়া সম্ভব?
-যদি কোন ব্যক্তি মডার্ণা বা ফাইজার ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে তবে তার ক্ষেত্রে রক্ত বা প্লাজমা দানে কোন বাধা নেই। তবে যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ধরণের ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে তবে তাকে রক্ত বা প্লাজমা দানের ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ বা ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হবে।

কি ধরনের ভ্যাক্সিন নেওয়া হয়েছে সেটা বোঝার উপায় কি?

-আমাদের দেশে অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনকা ভ্যাক্সিন আমদানী করা হয়েছে যা মূলত ভাইরাল ভেক্টর বা DNA ভ্যাক্সিন।

করোনা আক্রান্ত রোগী যারা পরবর্তীতে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছেন, তারা কি রক্ত দান করতে পারবেন?

-অবশ্যই। যদি তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে, পরবর্তীতে ভ্যাক্সিন গ্রহণের পরে বা ভ্যাক্সিন গ্রহণ না করলেও তারা রক্ত দিতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রে রক্ত দানের সবগুলো পূর্বশর্ত পরিপূর্ন হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।

কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হয়ে যান এবং ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেন, তবে সে ব্যক্তি কি জটিল করোনা রোগীদের প্লাজমা দান করতে পারবেন?

-যদি সে ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্লাজমা দান করতে পারবেন।

কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করলে কি যে কোনো ব্যক্তির কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে?

-ভ্যাক্সিনেশনের মূল উদ্দেশ্যই হলো করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। তবে ব্যক্তি বিশেষে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বা এন্টিবডি তৈরি হতে ভিন্ন রকম সময়ের প্রয়োজন হয়। কোভিড-১৯ এন্টিবডি পরীক্ষা করে সে সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এই পরীক্ষায় পজিটিভ ফলাফল শরীরে এন্টিবডি তৈরি হওয়া নিশ্চিত করে। যেহেতু আমাদের দেশে অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনকা ভ্যাক্সিন যা ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে দুটি ডোজে দেওয়া হচ্ছে, এমন হতে পারে কোন কোন ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের পর তার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হতে পারে। কারণ, প্রথম ডোজ গ্রহণের পর যদি সে ব্যক্তি রক্ত দান করে, তবে তার শরীরে এন্টিবডি তৈরির পর্যাপ্ত উপাদানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই ভ্যাক্সিন এর ২য় ডোজ গ্রহণের ৭-১০ দিন পর থেকে রক্ত দান করলে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা এন্টিবডি তৈরি হওয়া অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।

পরিশেষে বলা যায়, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় অন্যতম এক হাতিয়ার কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন। এটি গ্রহণের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। আবার কখনো কখনো মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত দান করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভ্যাক্সিন গ্রহণের পর সঠিক নির্দেশনা না মেনে রক্ত দান করলে ভ্যাক্সিন গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যেতে পারে। তাই জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে জরুরী ক্ষেত্রে রক্তদান করতে হলেও সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা আবশ্যক বা ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি।

নিজস্ব প্রতিবেদক/ ডা. টি এইচ এম এনায়েত উল্লাহ খান

হৃদিতা রোশনী:
Related Post