X

করোনার দিনগুলি- ১

রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০

দেশে করোনা ধরা পড়ার সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই মোস্তাক বলতো, “যে যত কথাই বলুক, আমার ধারণা বাংলাদেশে করোনা চলে এসেছে। এত বছর ধরে প্রাকটিস করছি, এত জ্বর, সর্দি, কাশির রোগী আগে দেখিনি। “গত মাসের এরকম সময়েই একদিন বললো, “আজ একটা জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টের রোগী দেখলাম। আল্লাহ্ ই জানে করোনা কিনা। “তখন করোনা টেস্ট এখনকার মত এত ব্যাপক আকারে হচ্ছিলো না। কাজেই জানার সুযোগ ছিল না। দুই একদিন বলছিল, শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না। বললাম, এই সিজন এ একটু শরীর খারাপ তো সবার ই হয়।

মোস্তাক এর শরীর খারাপ ভাব দূর হলো। কিন্তু গত মাসের বিশ তারিখ থেকে আমার খুশখুশে কাশি শুরু হলো। প্রায় প্রতি বছরই এই সময়ে একটু কাশি হয় আমার। কিন্তু এবার খুব ভয় লাগছিল আমার । আমি ফিজিওলজি পড়াই। কাজেই আমাকে রোগী দেখতে হয় না। কিন্তু ১৭ ই মার্চ এ অফিসের সব ডাক্তারদের সাথেই সবার আড্ডা হলো। আর তাছাড়া ঘরেই তো আমার স্বামী আছে, যাকে রোগী দেখতে হয়। কাজেই ভয়টা পিছু ছাড়ছিলো না।

আমি সবচেয়ে আতংকিত হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে, সিলেটে আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। খোদা না করুক, আমরা দুজনেই যদি আক্রান্ত হই, আমাদের বাচ্চা তিনটা কে যশোরে আমাদের আত্মীয় স্বজনের কাছে কে পৌঁছে দেবে? ওরা তো একা একা ঘরের বাইরে যাওয়াও শেখে নাই বা শিখাইনি। কোন বাচ্চাকেই আমি কখনো বাইরে একা একা ছাড়িনি। কি হবে বাচ্চাদের? এই প্রথম তীব্র ভাবে অনুভব করছিলাম, আত্মীয় স্বজন পাশে না থাকলে কেমন লাগে ।

তীব্র ভয়েই কিনা জানি না, পঁচিশ তারিখ দুপুর থেকে খুব খারাপ লাগছিল। সন্ধ্যার দিকে সামান্য জ্বর আসলো। বলে রাখা ভালো, সারাজীবন আমার তেমন অসুখ বিসুখ হয়নি (আলহামদুলিল্লাহ), এমনকি জ্বর ও না। যদিও পঁচিশ তারিখ সকাল থেকেই কাশিটা আর তেমন ছিল না, তবুও মোস্তাক বললো, আমার একটা রুমে আইসোলেশন এ থাকাই ভালো । আমারও তাই মনে হলো। আলাদা ঘরেই ঘুমিয়েছিলাম। রাত একটার দিকে হঠাৎই শ্বাস কষ্টে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেলকনিতে যেয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু খুব দম বন্ধ, দম বন্ধ লাগছিল । না পেরে ঘর থেকে বের হয়ে মোস্তাক কে ডাকলাম । বাচ্চাদের কে আর মোস্তাক কে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল । দেখি, আমার ছেলেটা তখনও ঘুমায়নি। কিভাবে ঘুমাবে? ও তো আমাকে ছাড়া কখনো ঘুমায়নি। আমার ছেলেটা উঠে আসতে চাইলো। ওকে বললাম,

“এসো না বাবা। আম্মুর কাছে এখন আসা যাবে না।”

মোস্তাক কে বললাম যে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাবু ঘুমালে বাইরে এসো। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের কে দেখতে থাকলাম।

আমার ছেলেও আমাকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেল। মোস্তাক বাইরে বের হয়ে আসলো। আমি তখন আবার আমার রুমে এসেছি। শ্বাসকষ্টটা সহ্য করতে পারছি না। মোস্তাক বললো,

“কিছু হবে না তোমার। বিকালেই তো দেখলাম, চেস্ট ক্লিয়ার।”

কিন্তু অজানা এই রোগ সম্পর্কে কারোরই তেমন ধারনা নেই দেখে, চিন্তার ভাঁজ তার কপালে ।

 

শ্বাসকষ্ট শেষ হচ্ছিলো না । মনে হচ্ছিলো, মৃত্যু আমার সামনেই। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি এসে যে কথাটা বারবার মনে হচ্ছিলো, সেটা হলো, আমার বাচ্চাদের কি হবে? মোস্তাক সারারাত আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ওকে ঘরের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছিলাম না আবার দরজার সামনে থেকে সরতেও দিচ্ছিলাম না । ওকে দেখতে দেখতেই মরতে চেয়েছিলাম। বারবার বলছিলাম, আমার বাচ্চারা যেন মায়ের অভাব বুঝতে না পারে। ও যেন ওদের কে বাবা মা দুজনের ভালোবাসা ই দেয়। আমার বাচ্চারা যেন কখনো মন খারাপ না করে। মোস্তাক বারবার বলছিল,

“তোমার কিছু হয়নি। তোমার কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ ।”

রাত চারটা পাঁচটার দিকে মোস্তাকের পরামর্শ মত একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাই।

লেখাঃ ডা. সুমনা তনু শিলা

সহকারী অধ্যাপক ( ফিজিওলজি ),

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ।

জামিল সিদ্দিকী: A dreamer who want to bring positive changes in health sector in Bangladesh.
Related Post