X

একজন ডাক্তার মায়ের আত্মকাহিনী

যেদিন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিলো জীবনের কাছে আর কিছুই চাওয়ার নেই। মানুষের চাহিদা যে আমৃত্যু তা বুঝতে কিছু সময় লেগেছিলো বৈকি। কালের পরিক্রমায় একদিনের পরম আরাধ্য বস্তু যে আরেকদিন উভয় সংকট হয়ে দেখা দিবে তা কে জানতো!

আজ বলবো প্রতিটি ডাক্তার মায়ের জীবনের করুণ কাহিনী। নিজের মাতৃসত্ত্বাকে পেশাগত দায়িত্ববোধের কাছে বিকিয়ে দেয়া সেই সব মায়েদের অব্যক্ত কষ্টের কথা।
সারাজীবন মেধাতালিকায় থাকা মেয়েটি স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে একসময় ঠাঁই করে নেয় সবার স্বপ্নের শিক্ষালয় মেডিকেল কলেজে। বাবামায়ের মুখের তৃপ্তির হাসি তাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। এরপরের গল্প শুধুই সংগ্রাম আর ত্যাগের। যখন তারই সমবয়সী স্কুলকলেজের বান্ধবীরা সেজেগুজে ঘুরতে বের হয়, সে তখন রিডিং রুম আর ইভিনিং ওয়ার্ড এ দৌড়ায়, সবাই যখন কাজিনের বিয়ের আনন্দে মেতে ওঠে, সে তখন প্রফের প্রস্তুতি নিতে গলদঘর্ম। এভাবে পেরিয়ে যায় আরও পাঁচটি বছর। সে ভাবে এবার বুঝি চূড়ান্ত সফলতা এলো, কিন্তু এখনো যে বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি। এরপর শুরু হয় সংসার আর চাকরি জীবনের দ্বৈরথ। ততোদিনে হয়তো তার কোলজুড়ে এসেছে নতুন প্রাণ। নতুন মা না পারে তার মাতৃত্ব উপভোগ করতে, না পারে সংসারের আনন্দ নিতে। কারণ সে তো শুধু মা নয়, সে যে অনেক বড় দায়িত্ব গ্রহনের শপথে আবদ্ধ। সে যে নিজের দুচোখে স্বপ্ন বুনেছে মানুষের সেবার। সেবার ঐ মহান ব্রত তাকে শেখায় সবার জন্য করতে চাইলে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ তো জলাণ্জলি দিতেই হবে। আর এসময় তার পাশে এসে তার স্বপ্নপূরণের সাথী হয় তার অতি নিকটজন, আত্মার আত্মীয়রা, যাদের ত্যাগ কোনো অংশেই তার নিজের ত্যাগের চেয়ে ছোট নয়।

মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হতেই তাকে চলে যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে, আর এতো যে সে কর্মক্ষেত্র নয়, দিনরাতের হিসাববিহীন কর্মক্ষেত্র। কখনো হয়তো অসুস্থ শিশুটিকে অসহায়ের মত ঘরে ফেলে রেখে চলে আসতে হয় আরো হাজারটা শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে। নিজের দুধের শিশু যখন মায়ের বুকের উষ্ণতা খুঁজে ফেরে মা হয়তো তখন সদ্য ভূমিষ্ঠ কোন নবজাতককে তার মায়ের বুকের উষ্ণতার খোঁজ দিচ্ছে। কত ডাক্তার মেয়ে যে সন্তানের মুখ চিন্তা করে নিরবে অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে তার খোঁজ কে রাখে? সে নিজে গর্ভবতী মা কে উপদেশ দেয় পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের, অথচ পুরোটা প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে সে নিজে কতটুকু বিশ্রাম পেয়েছে! এজন্যই বেশিরভাগ ডাক্তার মেয়ে বিভিন্ন গর্ভকালীন জটিলতায় ভোগে। এমনকি রোগীর ডেলিভারি করাতে গিয়ে রোগীর পায়ের আঘাতে ডাক্তারের নিজের এবরশন হয়েছে এমন ঘটনাও রয়েছে।

তারপর চলতে থাকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ম্যারাথন। হাসপাতাল, লাইব্রেরি আর মাঝে অল্প কিছুসময় নিজের সন্তান-সংসারের সাথে- এই হচ্ছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পথযাত্রীদের কাহিনী। এরও মাঝে চলে আরেক ধরণের করুণ কাহিনী। দূর্ঘটনাক্রমে যদি নিজ শরীরে আবারো নতুন প্রানের আহবান শুনতেও পায় তবে একজন ডাক্তার মায়ের অন্য মায়েদের মত খুশি হওয়ার অধিকার নেই। সে যে বহু আগেই এই অধিকার খুইয়ে বসে আছে। জগত সংসার তারদিকে বিরক্ত চোখে তাকায়, যে আছে তারই যত্ন নিতে পারেনা, অন্য প্রাণ দুনিয়াতে এনে কেবল স্নেহ বঞ্চিত করার কোনো অধিকার তার নেই। কত প্রান যে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে নিরবেই তাই ঝরে যায়, তা তো আর কেউ জানলো না। অসহায় ডাক্তার মায়ের নিরবে চোখেরজল ফেলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। সৌভাগ্যবানদের কাছে যদি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সোনার হরিণ ধরাও দেয়, এরপরও আছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক কঠিন লড়াই। এ লড়াই চলতেই থাকে। এরমধ্যে একদিন পিছন ফিরে সে দেখে তার বুকের মানিকের শৈশব তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে! আজ তা কেবলই অতীত।

ডা সাফিনাজ মেহজাবীন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ/ কে ৫৮

Platform:
Related Post