X

সন্তানের সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার 

ডা. আজাদ হাসান
সিওমেক ২১ ব্যাচ

টিন এইজড কিডসদের সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে পারাটা আসলে বর্তমানে অভিভাবকগণের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং বা খুব দূরূহ ব্যাপার।

কিশোর-কিশোরীদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বেশ জটিল সমীকরণের বিষয়। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেকে অনেক বেশী স্বাবলম্বি, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মনির্ভরশীল মনে করে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যে অপর্যাপ্ত এবং অপ্রতুল, তা তারা উপলব্ধি করে না।

এই বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে যেমন অবাধ স্বাধীনতা দেয়া উচিৎ নয়, আবার তেমনি কঠোর নিয়ন্ত্রণ করাও ঠিক নয়। বরং তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দেয়া উচিৎ।
তাদেরকে ‌সমাজ এবং বাস্তব জীবন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা দিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে যে সব গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করা হয়, সেগুলো কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। তাই পাঠ্য পুস্তকের জন্য প্রবন্ধ, গল্প কিংবা কবিতা নির্বাচনের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন বিষয়বস্তুগুলো কিশোর-কিশোরীদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়। নীতি-নৈতিকতা, আদর্শবোধ, সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, দেশপ্রেম এসব গুণাবলী সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ, এসব গুণাবলী অর্জন এবং ব্যক্তি জীবনে তার অনুশীলন মূলত এ বয়স হতেই কিশোর-কিশোরীদের শুরু করতে হবে।

আজকাল আমাদের সমাজের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক আছেন, যাদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় বড় হয় কাজের বুয়ার কাছে, বাবা-মায়ের যথাযথ পরিচর্যা বা খেয়াল তারা কখনও পায় না, কারণ তাদের বাবা-মা ওনাদের নিজস্ব পেশাগত দায়িত্ব পালনে অথবা সোশাল ওয়ার্ক নিয়ে অধিকতর ব্যস্ত থাকেন। সন্তানকে যথেষ্ট সঙ্গ দেওয়ার মতো সময় ওনাদের নেই। তাছাড়া আগে একান্নবর্তী পরিবারের মাঝে যে পারিবারিক বন্ধন ছিলো সেটিও আজকাল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এসব ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ নানা-নানী কিংবা দাদা-দাদীর স্নেহ-আদর হতে বঞ্চিত হয়। এসব ছেলেমেয়েরা কিশোর বয়সে পৌঁছালে মোবাইল গেমস অথবা ভিডিও গেমস নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে এবং এই সব কিশোর-কিশোরীরা এক ধরনের ফ্যান্টাসির মধ্যে বড় হয়। এদের জীবনে ব্যর্থতা বা অসফলতা বলতে কিছু নেই। যার ফলশ্রুতিতে এসব বাচ্চারা জীবনের বাস্তবতা হতে একেবারে অন্ধকারে থাকে। এ ধরনের বাচ্চারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক, একরোখা এবং স্বার্থপর হিসেবে গড়ে উঠে। এরা কিছুটা অসামাজিকও হয় বটে।

তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে শেখাতে হবে। আর তাই এই বয়সের কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশে সহায়ক বই, প্রকাশনা এবং কাউন্সিলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এমন কি সমবয়সীদের সাথে মেলামেশা করতে দিতে হবে, আবার সেই সাথে ওরা যাতে বিপদগামী না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।

কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য স্কুল কলেজে নিয়মিত আবৃত্তি অনুষ্ঠান, রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগীতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেয়ালিকা প্রকাশনা, বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশনার আয়োজন করতে হবে। তাছাড়া নিয়মিত খেলাধুলার পাশাপাশি, আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। বস্তুতঃ এসব কর্মকাণ্ড বা এক্টিভিটিজ এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বিদ্যালয়ের কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশে সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বস্তুত এসব কর্মকান্ড কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বি ও আত্মনির্ভরশীল হতে, আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে এবং সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রসংগত উল্লেখ্য কিশোর-কিশোরীদের জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। খেলাধুলা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক এবং শারীরিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে নিয়মানুবর্তিতা, নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা বা নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে টীমওয়ার্ক করার মানসিকতা গড়ে উঠে। সর্বোপরি প্রতিটি খেলায় জয় পরাজয় থাকে। সব সময় সবাই যে বিজয়ী হবে তা নয়, কখনো কখনো পরাজিতও হতে হয়। খেলাধুলা এই পরাজয়কে সহজ ভাবে নিয়ে নিজেকে ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তৈরী করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর এটাই হলো,”True spirit of sportsmanship”। আর বাস্তব জীবনে কোন কিছু না পাওয়ার ব্যর্থতার গ্লানি মুছতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এছাড়াও কিশোর-কিশোরীদের যথাযথভাবে মানসিক বিকাশের জন্য আরো প্রয়োজন প্রতিটি স্কুলের নিজস্ব লাইব্রেরী, অডিটোরিয়াম ও খেলার মাঠ থাকা।

তাছাড়া প্রত্যেক অভিভাবকের উচিৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বাচ্চাদের সময় দেয়া, মাঝে মাঝে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা স্থাপনা ভ্রমনে নিয়ে যাওয়া, লম্বা ছুটি পেলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। কেননা, এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল সবুজে ঘেরা আমাদের শাশ্বত গ্রাম বাংলার মাঝেই জড়িয়ে আছে আমাদের হাজারো বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য, আমাদের শেকড়।

Tanjim Rahman:
Related Post