X

শিশু পুষ্টিঃ অনলাইনে দেয়া শিশুদের জন্য হোমমেড ফর্মূলা কেন ক্ষতিকর

আমি তিন সন্তানের জননী । আমার ছোট সন্তানটির বয়স ২ মাস। একজন মা ছাড়াও আমার আরেকটি পরিচয় আমি একজন শিশুপুষ্টি ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাই অনেকটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিষয়টি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চেম্বারে কিছু অভিবাবক আসছেন তাদের বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা নিয়ে। বাচ্চাগুলোর বয়স ৭মাস থেকে ২ বছরের মাঝে। মায়েরা সবাই শিক্ষিত ও আধুনিক। সন্তান লালনের সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতা তারা পালন করেন। হিস্ট্রি নিতে গিয়ে জানতে পারলাম তারা বুকের দুধের পাশাপাশি সব ঘরে তৈরী খাবার বাচ্চাকে দেন। তাহলে পায়খানা কেন? ঘরে তৈরী খাবারের তালিকা নিতে গিয়ে জানতে পারলাম বাদামের হোমমেড ফর্মূলা,চালের গূড়ার হোমমেড ফর্মুলা,ডালের হোমমেড ফর্মুলার কথা- যার প্রত্যেকটি অনলাইনে পাওয়া এবং এগুলো খাওয়ানোর ৫-১০ দিনের মাঝে শিশুটির পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। একটি বাচ্চাকেতো আমার এগারো ব্যাগ স্যালাইন দেয়া লাগলো।

তাই আমি অনুরোধ করবো এসব খাবার বাচ্চাদের দিবেননা। কারনঃ-

১.একটি শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম ছয়মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোন কিছু হজম করার ক্ষমতা শিশুদের পাকস্হলির থাকেনা। এজন্যই আল্লাহপাক মায়ের বুকের দুধ দিয়েছেন। মায়ের দুধের উপকারিতা অন্য কোন দুধে শিশুটি পাবেনা। তাহলে আপনি কেন এত বড় নেয়ামত থেকে আপনার সন্তানকে বন্চিত করবেন?

২.জন্মের পর কোন রকম মিছরির পানি, চিনির পানি, মধু বাচ্চার মুখে দেয়া যাবেনা। যেটা দিতে হবে তা হলো শাল দুধ। সন্তান জন্মের ১/২ঘন্টা থেকে ২ ঘন্টার মধ্যে প্রথম যে দুধটি নিসৃত হয় সেটাই হলো শাল দুধ। শাল দুধ কে বলা হয় সকল রোগের মহৌষধ। যে বাচ্চা শালদুধ পাবে সে নবজাতক কালিন বিবিধ সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে।

৩.শিশুকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত কোন ভাবেই গরুর দুধ,ছাগলের দুধ দেয়া যাবেনা। কারন এসব দুধের অনেক উপাদান হজম করার মত পরিনত রস শিশুর পাকস্হলিতে থাকেনা। এসময় এ দুধগুলো দিলে শিশু বমি,পাতলা পায়খানা এরকম পেটের পীড়ায় ভোগে।

৩.ছয়মাস বয়সের পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি তোলা খাবার দিবেন। প্রথম শুরু করবেন পাতলা করে তৈরী চালের অথবা গমের সুজি দিয়ে(অনেকে পাকা কলার পিউরি দিয়েও শুরু করেন)। বাজারে এ বয়সোপযোগী ফর্মুলা (যেমন ল্যাকটোজেন ২,নান) এগুলো দিয়ে সুজি রান্না করবেন। এক আউন্স দুধে ১-২ চামচ রান্না করা সুজি মেশাবেন। যেদিন রাধবেন সেদিনই খাওয়াবেন। প্রথমে অল্প অল্প দিবেন তারপর পরিমান বাড়াবেন ।এভাবে ৭-১৫ দিন পর সুজির পাশাপাশি খিচুড়ী দিবেন ।

৪.খিচুড়ীর রেসিপি হলো একমুঠ চাল,১/২ মুঠ মসুরের ডাল,১ -২ চা চামচ সয়াবিন তেল,একটুকরা মুরগীর মাংস অথবা কলিজা অথবা মাছ,যেকোন একরকমের সব্জী যেমন মিষ্টি কুমড়া/পেপে/আলু ও একচিমটি লবন দিয়ে খিচুড়ী রান্না করবেন। অযথা একগাদা সব্জী দিয়ে কোন লাভ হবেনা। এটিও প্রথমে অল্প অল্প দিয়ে পরে পরিমান বাড়াতে হবে।

৫.এভাবে শিশুর বয়স সাত আট মাস হলে আস্তে আস্তে পাকা কলা,সিদ্ধ ডিম ( প্রথমে কুসুমটা দিবেন পরে ১০-১১ মাস থেকে সাদা অংশ দিবেন) এগুলো উপরোক্ত খাবার গুলোর সাথে যোগ করতে হবে।

৬. ১ বছর পর্যন্ত চিনি,মিষ্টি,চকলেট,ঘি ও লেবুজাতিয় খাবার শিশুকে না দেয়াই উত্তম।

৭. একবছরের পর থেকে শিশুকে সুজির হালুয়া,পায়েস,পুডিং,সেমাই,ভাত,মাংস এগুলো দিতে পারবেন। প্রতিদিন যে কোন একটি ফল শিশুর খাদ্যতালিকায় রাখুন।

৮. দেড়বছর থেকে আস্তে আস্তে শিশুটিকে ঘরে তৈরী সকল স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত করুন।

৯. দুইবছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য পর্যাপ্ত।কোনকারনে আপনি যদি বুকের দুধ দিতে না পারেন তাহলে বয়সোপযগী ফর্মুলা যেমন ল্যাকটোজেন,নান এগুলো দিতে পারেন ছয়মাস বয়সের পর থেকে। ছয়মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র বুকের দূধ দিতে হবে। ফর্মুলা দুধ দিলেও তা গ্লাসে/মগে/চামুচ বাটিতে খাওয়ানো অভ্যস্ত করুন।প্যকেটে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী তা তৈরী করুন।ফিডার ব্যাবহার না করা ই ভালো।

১০. সর্বোপরি সকল রকম বাজারজাত ফরমুলা সেটা গুড়ো দুধ,সেরিল্যাক,বেবি ফুড কিংবা অনলাইনের হোমমেড প্রিপারেশন -সবই শিশুর জন্য ক্ষতিকর।কারন এগুলো সবই প্রক্রিয়াজাতকরন।আর এ প্রক্রিয়াজাত করতে এমনসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যাবহার করা হয় যেগুলেো শিশুর বমি,পাতলা পায়খানা থেকে পরবর্তীতে অন্ত্রের ক্যান্সার পর্যন্ত করতে পারে। তাছাড়াও এসব প্যাকেটজাত খাবারগুলো হলো ব্যকটেরিয়ার ফ্যাক্টরী।যেগুলো শিশুদের পাতলা পায়খানা,রক্তপায়খানা করে।

১১. বড় বড় সুপারশপে যেসব বিদেশী বেবিফুডগুলো পাওয়া যায় সেগুলো ওইদেশের বাচ্চাদের আবহাওয়া ও জলবায়ু উপযোগী করে বানানো হয় তাই ওরা ওটা হজম করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের বাচ্চারা জ্বীনগত ও আবহাওয়ার কারনে তা হজম করতে পারেনা আর তখনই ঘটে যত বিপত্তি।

অতএব আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তান সুস্থ থাকুক, সন্তান পরিপূর্ন পুষ্টিকর খাবার পাক। আর এটা একমাত্র দিতে পারে ঘরে তৈরী প্রাকৃতিক উপাদানে ভরপুর স্বাভাবিক খাবার।সুতরাং আসুন আমরা সবাই সকলরকম বাজারজাত শিশুখাদ্য বর্জন করি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এদের চোখ ধাঁধানো এ্যাডে আকৃষ্ট হয়ে তাদের ব্যাবসায়িক স্বার্থ রক্ষা না করে নিজের সন্তানের ভালোটা ভাবি।

……………………
ডাঃসাদিকা কাদির(এম.বি.বি.এস,এম ডি)
৩৯তম ব্যাচ,সি.ও.মে.ক
শিশু পুষ্টি ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক
জেড,এইচ,সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ,ঢাকা

drferdous:
Related Post