X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড সিক্সটি টু

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আত্মসম্মানও একটি সীমার পর মাথা নিচু করতে ঘৃণাবোধ করে। আর কত! এদেশে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম ‘বিয়ে’।

গতকাল এক কন্যার বাপ তার অধনস্ত এক ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠিয়েছেন আমার সাথে দেখা করতে। উনি আমাদের পঁচা পঁচা ডর্মিটরিগুলো দেখার পর পুরো রিপেয়ারের আশ্বাস দিয়ে আমাকে নিয়ে বসলেন। যেন আমি কোনো দালান, আমি আমার ভাঙ্গাচোরা দেখাবো- উনি বালু সিমেন্টে সমাধান দিবেন। একটি নাটক বছরের পর বছর চলে আসছে। ‘দেখা’, ছেলে দেখা মেয়ে দেখা। যেন কেউ তার আসল এংরি ফেসটা দেখাবে স্মাইলিং ফেস ঢেকে রেখে। তারপর ছবি বিনিময়। যে ছবি কন্যাটি তার স্বীয় ভাবী পতিস্বরূপ দেখবে। আর ছেলেটি দেখবে আকাশ কুসুম স্বপ্ন। তাদের ততক্ষণ ভাল চলবে যতক্ষণে না তারা প্রেমে পড়ছে। কারন প্রেমের রাস্তা পিচ্ছিল- সে দুই স্টেপ নেমেই গলা পানিতে হাবুডুবু খায়। তা সে বাপ মা অনুমোদিত হোক বা না হোক।

বলা হয় যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তার মূল্য তত বেশি। সে মূল্যও সঠিক মূল্য নয়, আরোপিত। এখানে গুণ দোষের বিচার হয় না। ‘দোষ’ তো রীতিমত শূন্য হয়ে যায় যখন সে একবার অধীনস্হ থাকে। আপনার সবচেয়ে দামি জিনিসটি কী আপনি এখনো জানেন না। তখনি জানবেন যখন সেটি হারাবেন। বিয়ের আলোচনায় সবাই হার জিতের ভাবনা ভাবতে থাকে। অথচ ভাবা উচিত ‘হারানোর সম্ভাবনা’। কে কি হারাতে পারে। ভদ্রলোক আমার চোদ্দগুষ্টির ইতিহাস কাগজে লিখে নিয়ে গেলেন। যা তাদের কোনো কাজেই আসবে না!

ছবি – প্রতীকী

নতুন বস এসেছেন। হাসপাতাল গতিশীল রাখতে উনি অফিস ঘন্টার পরে মিটিং ডাকছেন। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মিটিং হলো। দেয়াল ঘড়ির দিকে সবাই এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে ভয় হচ্ছিল ঘড়ির কাঁটা না ক্ষয়ে যায়! অবশ্য প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়েও সবাই হাসিমুখ ধরে রেখেছে। ব্যক্তি সমাজের স্বস্তির জন্য অনেক ব্যক্তিগত অস্বস্তিকে ঢেকে রাখে- এই বড় স্বস্তির কথা!

সময় চলছে। হিসেব কষে দেখি এ চাকরি আমার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাকরির সময়সীমায় উঠে যাচ্ছে। মানুষ তো সার্কাসের প্রাণী না যে এক জায়গায় থেকে একি কাজ করবে সারাজীবন। করতে হয় কারণ পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীণতম ফেস। পৃথিবীই পিরামিড। উপরটা সরু। তবে সে থাকাও খুব বেশি মন্দ হয় না যদি টান থাকে। সম্প্রতি আশা ভোঁসলের বয়স ৮৮ বছর হয়েছে। উনি জন্মদিনে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। উনার সাক্ষাৎকারে এক বড় ভুল ভাঙ্গলো। আগে ভাবতাম আমাদের সিনিয়ররা রোগী দেখে দেখেই জীবন শেষ করে দিলেন- এটা কোনো জীবন? তারা যে খুব বেশি ভোগ করেন এমনও না। উল্টো কোভিডেও অনেক মারা গেছেন। আসলে তারা এটাই এনজয় করেন। এটাই প্যাশন।

আশা ভোঁসলে বলেছেন ”যদি আমার কন্ঠ যায় সে যেন আমার সাথেই যায়, আমার আগে নয়। আমার কন্ঠের জন্যই আমি। আমি ততদিনই বাঁচব যতদিন আমার গলা বাঁচবে। আমি কোনোদিন দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করি নি, পার্থিব কিছু চাইও নি, আমি শুধু চেয়েছি আমার গলাটা যেন কখনো বুড়া না হয়।” অবসরে গিয়েও যে বুড়ারা শত কাজ করে সে ব্যস্ত থাকার জন্যই করে, প্যাশনেই করে। সবসময় টাকার জন্য করে না।

এরমাঝেই এক মা তার নয় মাসের বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। দেখলাম ডান পাশের বুক ফুলে আছে। বিছানা থেকে পড়ে গেছিলো চারদিন আগে। এখন ব্যথায় শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। স্টেথোস্কোপ ছুঁয়াতে দেয় না। এক্সরে করে নিয়ে এসেছে- উল্টেপাল্টে দেখলাম কোথাও ভাঙ্গে নি। অত ছোট বাচ্চা কত বড় ব্যথা নিয়ে শুয়ে আছে! শিশু রোগী চিকিৎসা করা খুব কঠিন। ওরা কিছু বলে না শুধু চেয়ে থাকে। কার কাছে রেফার করা যায় ভাবতে ভাবতে বললাম- এতো পরে আনলেন কেন? বললো ‘টাকা ছিল না। চারদিন ধরে টাকা যোগাড় করছি’। হায় রে আমার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স- ঢাকা মেডিকেল কলেজ পিজি হাসপাতাল!! জনপ্রতিনিধি তো বলে দিয়েছেন! বুকের এক্সরে পর্যন্ত হয় না। মাকে আর কিছু বললাম না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন- “সংসার যে কি ভয়ানক জায়গা, দুঃখে-কষ্টে না পড়লে বোঝা যায় না।”

কী যে এক সময় এলো- কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। এখন বেশিরভাগ সময় বাইকে যাই আসি। বাইক তো চালাতে জানি না, পিছনে বসি। পিপিই রেনকোট হিসেবে ব্যবহার করি। বৃষ্টি হয়। জলকনা হেলমেটে আটকে থাকে। বাতাসে জলকনা পেছনদিকে উড়ে গিয়ে ঝাপসা দৃষ্টি পরিস্কার করে দেয়। গতির নেশা বড় নেশা। এর কোনো এন্টিডট নেই।

দূরের আকাশে মেঘ জমে আছে। তার পরে সোনালি আকাশ। ওদিকে যেন আজ রাজকন্যার বিয়ে। মেঘেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কোন এক কালিদাস আজ মেঘে মেঘে কবিতা লিখবেন। যে বিদুষী রাজকন্যা তাঁকে ‘মূর্খ’ বলে ঘর থেকে বিদায় করে দিয়েছে- তাকে উদ্দেশ্য করে তার বিরহের কবিতা। এ পাশে অসংখ্য মাছ ধরার ফাঁদ। কোনোমতেই যেন কোনো ভুলে মাছ ছুটে না যায়।

Platform:
Related Post