X

ভুলভাবে বানানো খাবার স্যালাইন হতে পারে মৃত্যুর কারন

লিখেছেন ঃ ডাঃ কামরুন নাহার, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আমার ক্লিনিক্যাল এসিস্টান্টসিপ এর মাঝামাঝি সময়। চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু বিভাগের ডায়রিয়া ব্লকটা বারান্দায় এবং একটু অবহেলিতও বটে। কারণ এই রোগীরা ক্রমাগত পাতলা পায়খানা আর বমি করতে থাকে। সেজন্য সেখানে গন্ধ বেশী, তদুপরি টয়লেটের পাশে হওয়ায় পরিষ্কার আর গন্ধমুক্ত রাখা খুব কঠিন । এই ব্লকটা ছোঁয়াচেও বটে। আমার HMO আর IMO রা ঐদিকে  সহজে যেতে চায় না। তাই সেটা আমি দেখি।

সকাল ৭:৪৫ । কিছুক্ষন পরেই মর্নিং সেশন এর কাঠগডায় দাঁড়াতে হবে। তার আগে খারাপ রোগীগুলো দেখে নেয়ার চেষ্টা। একটা ৮ মাসের বাচ্চা । ডায়রিয়ার রোগী।সেমি কনসাস, অনেক জ্বর ১০৩.৫। জিহবাটা একদম শুকনো। এই অবস্থাতেই দুধ মুখে দিলে চুষছে । মানে সে ভীষন তৃষ্ণারত , পেট টা ফোলা ফোলা। ৬/৭ ঘন্টা প্রসাব করেনি।
মনে হল এতো জ্বর! ম্যালেরিয়া নাতো? বারান্দায় রোগি কম দেখা হয় বিধায় ওকে ওয়ার্ডের ভিতর নিয়ে আসলাম। হিস্ট্রি নিয়ে জানলাম, ২ দিন ধরে ডায়রিয়া। তার মা তাকে ওর স্যালাইন (ORS)খাইয়েছে ৫ পেকেট কিনতু ors টা গুলিয়েছে অল্প অল্প করে । পুরো প্যাকেট একসাথে নয় । ভয় পেলাম খুব। বুঝলাম তার শরীরে লবনাধিক্য(hypernatremia) হয়েছে । সোডিয়াম লেভেল কত জানা যাচ্ছে না । তখন পেডিয়েটরিক আইসিইউ   হয় নাই। আমাদের। এসব রোগীর চিকিৎসা খুব কঠিন। বেশীর ভাগ রোগি মারা যায় । কারণ এটা খুব সাবধানে আস্তে আস্তে (slow correction) করতে হয়। নাহলে ব্রেইনে পানি ( cerebral edema) জমে রোগী মারা যায়। ব্রেইনে কখন কখন রক্তক্ষরণও হতে পারে।
সামান্য ডায়রিয়া। ORS দিতে হয় পানি শুন্যতা রোধে কিন্তু সঠিক প্রয়োগ না জানাতে এটাই রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে যায়। এই রোগীর সোডিয়াম লেভেল ছিল ১৭১ মিলিমোল (১৩৫ পর্যন্ত নরমাল)। এক সপ্তাহ জমে মতে মানুষে টানাটানি করে রোগী বাঁচানো যায়।
যে জন্য এই গল্পের অবতারনা। কচকচে বই এর ভাষা লেখলে কেউ পড়বেনা।

ORS ICDDRB এর একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। কিন্তু ব্যবহার বিধি না জানার কারণে এটাই মাঝে মাঝে মৃত্যুর কারণ হয়।
অনেকেই স্যালইন গুলাতে জানেন না ।

১.ORS গুলোর আগে প্যাকেটের গায়ের লেখা পড়ে নিন । কোনটা ১ লিটার , কোনটা ৫০০ মিলি , কোনটা ২৫০ মিলি তে গুলাতে হয়। একমাত্র প্যাকেটের গায়ে লেখা পডলেই বুঝতে পারবেন  কতটুকু পানি লাগবে।যেমন ঃ SMC’র ORS টা ৫০০ মিলি পানিতে গুলাতে হয়, টেষ্টি স্যালাইন ২৫০ পানিতে গুলাতে হয় । তাই গুলানোর আগে অবশ্যই প্যাকেটের গায়ে লেখাটা পড়ে নিন।

২. ৫০০ মিলি পানি মাপতে ৫০০ মিলি মিনারেল ওয়াটারের বোতল ব্যবহার করুন। কোন মগ বা গ্লাস ব্যবহার করবেন না। পানির পরিমাণ কম বেশি হলে মারাত্মক সমস্যা হয়। রোগির লবনাধিক্য বা লবনস্বল্পতা দেখা যায় যার চিকিৎসা খুব কঠিন।

৩. গরম পানিতে স্যালাইন কখনই গুলানো যাবেনা। পানি সিদ্ধ করে ঠান্ডা করে নিন।
রোগীকে জানতে হবে স্যালাইন খেলে ঠাণ্ডা লাগেনা। ঠাণ্ডা লগার ভয়ে অনেকে স্যলাইন খাওয়ায় না।

৪. পুরো প্যাকেট একসাথে গুলিয়ে নিতে হবে প্যাকেটের গায়ের লেখার সম পরিমান পানি নিয়ে। অল্প স্যালাইন অল্প পানি এভাবে গুলানো যাবেনা। আধ প্যাকেট স্যলাইন রেখে দিয়ে আধ প্যাকেট গুলানো যাবে না । অনেকে মনে করেন বাচ্চা ছোট এত স্যালাইন খেতে পারবেনা,(হসপিটালের অভিজ্ঞতা) তাই তারা আধ প্যাকেট গুলিয়ে খায়।
পুরো প্যাকেট একসাথে গুলান। ১২ ঘন্টা পর যা থাকবে ফেলে দিন । লাগলে আবার নতুন প্যাকেট গুলান। ORS এর দাম ৫ টাকা । বাচ্চার দাম টাকা দিয়ে পরিমাপ করলে হবে কি?

৫. ডাবের পানি দিয়ে স্যালাইন গুলানো যাবেনা। অনেককে তাই করতে দেখেছি। বেশী ডায়রিয়া হলে ২ প্যাকেট দিয়ে ৫০০মিলি পানিতেও গুলাতে দেখেছি । এটা মারাত্মক ক্ষতিকর।

৬. বেশীর ভাগ ডায়রিয়াতে ওষুধ লাগেনা। পানি শুন্যতা পুরনের জন্য ORS দিলেই চলে। কিন্তু ORS এক সাথে বেশিবেশি খাওয়ানো যাবে না। কারণ ডায়রিয়ার সময় অন্ত্রের পানি শোষণ ক্ষমতা কমে যায় । তাই একসাথে বেশী স্যালাইন দিলে তা সাথে সাথে পায়খানার সাথে বেরিয়ে যায়।

অতএব অল্প অল্প করে বারবার স্যলাইন খাওয়ান । সবচাইতে ভাল মিনিটে ১ চামচ করে । বমি থাকলে ২ থেকে ৩ মিনিটে ১ চামচ দিবেন।

৭. সবশেষ বলব আমাদের টেলিভিশনে এ বিষয়ক কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করা  হয় না ।
নিয়মিত টিভিতে স্যালাইন বানানোর নিয়ম দেখানো উচিত । বিভিন্ন টেলিফোন কোম্পানিগুলো অনেক সুন্দর সুন্দর বিজ্ঞাপন বানায় । জনস্বার্থে এই ধরনের বিজ্ঞাপন কি বানানো যায় না?

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

View Comments (2)

Related Post