X

ভিয়েতনামের ৯১তম করোনা রোগি এবং ডা. সমিরুল ইসলামের মৃত্যু

২৬ জুন ২০২০, শুক্রবার

মানব কুমার চৌধুরী
ইএনটি কনসালটেন্ট,
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল।

গতপরশু দিন দুপুরে ডা. সমিরুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক অর্থোপেডিক সার্জারি  চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পুরো চট্টগ্রামকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন।
কে এই ডা. সমিরুল ইসলাম?
ডা. সমিরুল ইসলাম চট্টগ্রামের আর ২০,৩০ জন অর্থোপেডিক সার্জনদের একজন।
তবে ডা. সমিরুল ইসলাম  ছিলেন বেশ ব্যতিক্রম।
প্রথমত তার হাতের কাজ খুবই নিঁখুত, কাজ করতো নিজে, গৌরাঙ্গ নির্ভর সার্জন ছিলেন না।

মানুষ হিসাবে ছিলেন অসাধারন।
বেশ কিছুদিন আগে আমার এক প্রতিবেশি বছর তিরিশের হবে সৌদি থেকে এসে আমাকে ধরলেন, ওখানে নাকি তাকে পরামর্শ দিয়েছে তার একটা হিপ রিপ্লেস করতে হবে।
সেখানে প্রচুর খরচ।
আমাকে বলে সে লাখ দেড়েক বাজেট করেছে, আমি যেন কাজটি করিয়ে দিই।
আমি একটা ছোট নোট লিখে ডা. সমিরুল ইসলামের কাছে পাঠালাম, কাজটা করে দেওয়ার জন্য।
রোগি উনার চেম্বারে গিয়ে ফিরে এসে বললো কাজটা করা যাবে না।
আমি একটু আশ্চর্য হয়ে আমার হাসপাতালের ম্যানেজারকে বললাম ডা. সমিরুল ইসলাম পরদিন আসলে যেন জেনে নেয় ব্যাপারটা কি!

আমি যা শুনলাম তা হলো হিপ প্রোসথেসিস করলে ৫,৭ বছর পরপর ওটা পাল্টাতে হয়। এ লোকের যেহেতু বয়স কম তাই তারটা বহুবার পাল্টাতে হবে, এত খরচ সে পারবে না। তা ছাড়া লোকটা এখনো তেমন সমস্যা বোধ করছে না। তাই যত দিন পারে চলুক, পরে করলে ও চলবে।
পুরো ব্যাপারটা রোগিকে বুঝিয়ে দিলাম, আপাতত টাকাটা জমা রেখে দেন পরে করবেন।
চিন্তা করলাম ডা. সমিরুল ইসলামের জায়গায় অন্য কেউ হলে এত কিছু চিন্তাই করতো না। নগদ যা পাওয়া যায় তাই পকেটে পুরতো।

যেখানে করোনাকালেও এদেশে মাথা ফাটিয়ে ডা. মারার ঘটনা ৩-৪ দিন আগেই ঘটেছে, সেখানে ডা. সমিরুল ইসলামের জন্য মেডিকেল নন মেডিকেল পুরো চট্টগ্রাম কাঁদছে।
ডা. সমিরুল ইসলাম করোনা আক্রান্ত হয় প্রায় দেড় মাস আগে। শুরুর দিকে বেশ খারাপ ছিল। হাইফ্লো অক্সিজেন প্লাজমা দুটোই চট্টগ্রামে উনিই প্রথম  পেয়েছেন। মোটামুটি সুস্থও হয়ে গেছেন সপ্তাহ দুয়েক আগে। ভাইরাস মুক্ত ও হয়েছিলেন।

যেহেতু প্রথম বারেই ফুসফুস বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তাই উনার শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি দুর হয়নি। অল্প অক্সিজেন নিয়েই মোটামুটি সুস্থ ছিল। গতকাল হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট হয়ে ভেন্টিলেটারে দিতে দিতেই মারা গেলেন।
এ রকম কেস দেশে প্রথম হলেও বিদেশে এরকম প্রচুর ঘটনা ঘটছে। lung fibrosis কেই কারন মনে করা হচ্ছে।

ভিয়েতনামের ৯১ নং কোভিড কেস কি?
ভিয়েতনাম বর্তমান করোনা কালে একমাত্র দেশ যারা একজনও কোভিড রোগিকে মরতে দেয় নাই।যদিও আমাদের টিভি চ্যানেল গুলো প্রতিদিন আমেরিকা, ব্রিটেন এসব ফেল মারা দেশের বিশেষজ্ঞের সাথেই নানা রকম আলাপ পরামর্শ করছে।

কেমনে সম্ভব হলো?
ভিয়েতনাম চিনের পাশের দেশ। দুদেশের মাঝে কমন সীমান্ত ১৫০০ কি.মি. এর বেশি। ভিয়েতনামের প্রচুর লোক বিদেশে কাজ করে। সংক্রমনের শুরুতেই ভিয়েতনাম করোনার বিরুদ্ধে লিখিত যুদ্ধ ঘোষনা করে। লক ডাউন মানে লক ডাউন। আমাদের মতো ছুটি নয়। প্রত্যেক বিদেশ ফেরতকে বিমান বন্দরে কোয়ারাইন্টাইন করে। ব্যাপক টেস্ট

কন্টাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশান, চিকিৎসা করে দু’মাসের মাথায় করোনাকে পুরোপুরি আয়ত্বে নিয়ে আসে। মার্চ ১৮ তারিখে একজন ব্রিটিশ পাইলট ৪৩ বছর বয়স গুরুতর করোনা আক্রান্ত হয়। সে ছিল ৯১ তম কোভিড রোগি। হাইফ্লো অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর কোনকিছুই তার অক্সিজেন লেভেল মেনটেইন করতে পারছিল না।
অবশেষে ভিয়েতনামের শীর্ষ চিকিৎসকগন জটিল এবং কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেন।

কি সেটা?
ECMO. আমরা যাকে হার্ট, লাং মেশিন বলি
তাকে ECMO মেশিনে দেওয়া হয়। তখন দেখা গেলো তার ফুসফুসের ১০% কাজ করছে। ৯০% কাজ করছে না। আমাদের দেশে হলে ডা. সমিরুল ইসলামের মতোই পরিনতি হতো। ওটাতো ভিয়েতনাম! বাংলাদেশ নয়। আমরা ফেসবুকে রাজা উজির মারি আর ওরা কাজ করে বাস্তবে।

উনারা সিদ্ধান্ত নিলো একজন সুইট্যাবল ডোনার পেলে তার ফুসফুস প্রতিস্থাপন করবেন। সেটা যতদিন লাগবে লাগুক।ততদিন ECMO সাপোর্ট দেবে।
ডোনার পাওয়া যায়নি। ৮২ দিন পরে, দেখা যায় পাইলট ভদ্রলোকের ফুসফুস নিজে থেকে কিছুটা কাজ করছে। তারা পরিমাপ করে দেখে সেটা ৬০%।

ওরা ECMO মেশিন খুলে দেয়।
তেমন কোন শ্বাসকষ্ট নেই।
ইতি মধ্যে ওদের দেশে ৩৩২ জন রোগির সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছে। একজনও মারা যায়নি। মারা যেতে দেয়নি। নতুন রোগি তো নেই বহুদিন ধরে!

আমাদের ডা. সমিরুল ইসলাম তো আর ভিয়েতনামে জন্ম নেননি, যে সে ECMO র সাপোর্ট পাবে। হয়ত ১৫দিন, ৩০দিন বা ৬০ দিন ECMO র সাপোর্ট পেলে ডা. সমিরুল ইসলামের ফুসফুস ভালও হয়ে যেতো।
ইতিমধ্যে অস্ট্রিয়া এবং ইউএসএতে একজন করে করোনা রোগির ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা হয়ে গেছে। তারা ভালই আছে।

বিঃদ্রঃ ভিয়েতনাম আমেরিকা বা ইউরোপের কোন হাইটেক দেশ নয়। ওরা চায়নাদের জাতভাই। কুত্তা, বিড়াল ইঁদুর এসব খায়। ওদের সরকারি হাসপাতালে এখনো লতাপাতা, শিকড় এসব চিকিৎসা দেওয়া হয়, হাসপাতাল থেকেই এসব লতাপাতা সরবরাহ দেওয়া হয়।

আমাদের দেশে!
কত শত মেডিকেল কলেজ আর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
শতশত বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান।
ফলাফল আমাদের দেশে ভাইরাস কোথায় সেটাই জানি না বিধায় অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছি! (চাইনিজ প্রতিনিধির মতামত!)।
আর ভিয়েতনাম! ওরা ECMO মেশিন ব্যবহার করে হলেও একজন করোনা রোগিকে ও মরতে দেয় নাই।

Sarif Sahriar:
Related Post