X

দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-৭

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৯ আগষ্ট ২০২০, রবিবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।

প্রথমবার বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে আসার সাথে আমার ব্যক্তিগত একটা সুখের অনুভূতি কাজ করে। বাংলাদেশে অনারারী ট্রেইনিং এর পাশাপাশি দু’জনেই স্বল্পবেতনের চাকরি করতাম। নিজেদের খরচ, সাংসারিক খরচের বাইরে কোন বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না। পরিবারের কাউকে মনের মতো করে উপহার দিতে পারতাম না, বিয়ের দাওয়াত তো কিছুটা আতংকের মতো লাগতো, খুঁজে বের করতাম কি কিনলে সন্মান আর পকেট দুইই বাঁচে। সেই প্রথম আমি সবার জন্য মনের খুশিতে উপহার কিনলাম। আমার মনে আছে, আমার হাজব্যান্ড পাঁচ পাতার এক লিস্ট করে, যাতে দু’পক্ষের আত্মীয় স্বজনের নাম আর উপহার সামগ্রী লিখা ছিলো, বাদ যাবে না একটি শিশু ও! এরপরেও আমি অনেকবার দেশে এসেছি, আরও অনেক গিফট কিনেছি, কিন্তু সেইবারের দেয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ ছিলো।

ছুটি শেষে আবার ওমান ফিরে আসলাম। আবার শুরু গতানুগতিক জীবনের। ততদিনে পুরোপুরিই অভ্যস্ত হয়ে গেছি হাসপাতালের নিয়মকানুনের সাথে। এখানে রোগী সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম তা বলা যায়, তবে দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা, ডকুমেন্টেশন কাজটাকে সময়সাপেক্ষ করে তোলে। যেহেতু এটি স্পেশালাইজড ক্লিনিক প্রায় কোন রোগীই সরাসরি এখানে আসতে পারেনা। প্রথমে প্রাথমিক হেলথ সেন্টার থেকে রেফার‍্যাল এর চিঠি লাগে। রোগের ধরণ ও জরুরী অবস্থার বিবেচনায় ঠিক করা হয় রোগী কখন এপয়েন্টমেন্ট পাবে। খুব জরুরী অবস্থা হলে, লেবার রুমের পাশে গাইনি ইমার্জেন্সি রুমে দেখাতে হয়, একজন ডাক্তার সার্বক্ষণিক ফোন সাথে রাখেন, যে ওয়ার্ডের রোগীর পাশাপাশি ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীও দেখেন।

ওমানে আমি হাতে গোনা কয়েকজন রোগী দেখেছি এক্লাম্পসিয়ার। অথচ বাংলাদেশে একটা ওয়ার্ডই থাকে শুধু এক্লাম্পসিয়া রোগীর জন্য, শীতকালে সেই ওয়ার্ডে তিল ধারণের জায়গা থাকতো না। ওমানে কিন্তু প্রেগ্ন্যান্সিজনিত উচ্চরক্তচাপ কিংবা প্রি-এক্লাম্পসিয়া রোগীর অভাব নেই। গড় ওজন অনেক বেশী হওয়াতে ওদের মধ্যে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের হারও অনেক বেশি। তবে যেভাবে তাদের ফলো আপ করা হয় আর পরিকল্পিত ডেলিভারি করা হয়, প্রি-এক্লাম্পসিয়া রোগী এক্লাম্পসিয়ায় গড়াতে পারেনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

সব প্রসূতি রোগী প্রথমেই হেলথ সেন্টারে রেজিষ্ট্রেশন করেন, একটা সবুজ কার্ড দেয়া হয়, যেটাতে তার এন্টিন্যাটাল চেক আপের সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হয়, কম্পিউটারে লেখার পাশাপাশি। বিশ থেকে চব্বিশ সপ্তাহের মধ্যে একবার স্পেশালাইজড ক্লিনিকে দেখিয়ে যদি সবকিছু ঠিক থাকে পরবর্তীতে আবার হেলথ সেন্টারেই ফলো আপ করে ডেলিভারির আগ অব্দি। আর যদি কোন ঝুঁকির ব্যাপার পাওয়া যায়, আবার এই ক্লিনিকে ফলো আপ করেন। কোন রোগী যদি অত্যন্ত ঝুঁকির মনে করা হয়, যেমন এম.আর.আই. করে “প্লাসেন্টা এক্রিটা” পাওয়া গেছে, সেক্ষেত্রে অনেক সময় রোগীকে মাস্কাট পাঠানো হয়।

এই যে প্রাথমিক হেলথ সেন্টার থেকে সেকেন্ডারি কেয়ার, তা থেকে টারসিয়ারি কেয়ারে পাঠানোর ব্যাপারগুলো দেখলে বাংলাদেশের কথা ভেবে একটু দুঃখ লাগতো। তৃতীয়/চতুর্থ বর্ষে কমিউনিটি মেডিসিনের বইয়ের পাতায় দেখেছিলাম বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অর্গানোগ্রাম, একদম একই রকম। তবে তা কাগজে কলমেই। আদতে বাংলাদেশের মানুষ তার থোড়াই কেয়ার করে, অপ্রয়োজনীয় রোগীতে ভরে যায়। এতো রোগীর মাঝে কোন রোগীকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, তা ঠিক করা বেশ দুরূহ কাজই বটে। তবে সত্যিকার অর্থে যদি এটা মেনে চলা যেত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে যেত বলে আমার ধারণা।

বাংলাদেশে আউটডোরে রোগী দেখার স্মৃতি মনে পড়লো। একবার একজন সিনিয়র আপার সাথে রোগী দেখসিলাম। রোগী রুমে ঢুকার পর উনার প্রথম কথা থাকতো “কাপড় তুলে পেট বের করে বিছানায় শুয়ে পড়েন”, মানে প্রসূতি মায়ের পরীক্ষার জন্য। প্রথমদিন শুনে চমকে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, আমার বাড়তি কথা বলাটা উনার পছন্দ হচ্ছে না, বা মনে করছেন আমি রোগী দেখতে সময় বেশি লাগছে। পরে আমিও তাই বলা শুরু করলাম। পরে একদিন আউটডোরে একই কথা বলার পর সিনিয়র ভাই কটমট করে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন এভাবে বলা ঠিক নয়। বড়জোর আপনি পাঁচ জন রোগী বেশি দেখবেন। এই সিনিয়র ভাইয়ার কাছেই আমি প্রথম জেনেছি  কত সুন্দর ভাবে কাউন্সেলিং করা যায়, রোগীকে ছবি এঁকে এঁকে তার সমস্যা বোঝাতেন।

এর মধ্যে আমাদের কানাডার ইমিগ্রেশনের চূড়ান্ত চিঠি আসলো। আমরা কানাডা পাড়ি জমালাম, তবে সাময়িক দেড় মাসের ছুটি নিয়ে। আমার বন্ধু ভাগ্য বরাবরই ভালো। কানাডার বন্ধুদের আতিথেয়তায় কখন সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। ঘোরা হয়েছে অনেকগুলো শহর। অসাধারণ শান্ত লেক, দর্শনীয় স্থানে পরিপূর্ণ আর বিশাল নায়াগ্রায় গিয়ে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সামনে নিজেকে শুধুই ক্ষুদ্র মনে হয়েছে।

কানাডার মানুষদের দেখে প্রথমেই মনে হয়েছে তারা ভদ্র, বিনয়ী। কতবার এমন হয়েছে রাস্তায় ঠিকানা জানতে চেয়েছি, সে অনেকটুকু এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশি মানুষেরা সাধারণত চেহারা শক্ত করে চলে অভ্যস্ত, হাসলে আবার কে কি মনে করে। এখানে অপরিচিত মানুষও এলিভেটরে দেখলে স্মিত হাসি দেয়, ফিরতি হাসি বিনিময় না করে পারা যায়না। ছুটি শেষ, কিন্তু আমাদের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড তখনও আসেনি। ঠিক হলো, আমার হাজব্যান্ড থেকে যাবেন, কিন্তু আমি মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলাম।

Sarif Sahriar:
Related Post