X

”জলে ভেজা জীবন” রোগী কথনঃ ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা

জলে ভেজা জীবন
রোগী কথনঃ ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা

আমি ছিলাম অদ্ভুত রকমের! বাপ মায়ের বড় সন্তান। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় দাদির মুখ কালো হলেও বাবা ছিলো উদ্ভাসিত, আমার আলোয় আলোকিত। বাবা আমাকে খুব আদর করতেন। প্রায় মাকে বলতেন, সুন্দর কাফর ছোফর পিন্দাইলে আমার মাইয়ারে পরীর মতোন লাগে। কেউ কইত না আমার মাইয়া। ভুল কইরা চান্দের টুকরা আমার ভাংগা ঘরে ঢুইকা পড়ছে, তুই কিন্তু আমার মাইয়ার অযত্ন করবি না। বাবার কান্ড কারখানায় দাদি বেজার হইলেও মা মুখ টিপে হাসতেন। আমার সে সুখ আর বেশিদিন টিকল না। পর পর তিন বোন আমরা, একখান ছেলের আশায় মা আবার পোয়াতি। অভাবের সংসার। চৌদ্দ বছরের আমার ঠাঁই হয় শশুড়বাড়ি। ছেলে স্বভাব চরিত্রে ভালো, কাজকর্ম যখন যা পায়, তা করে। ঘরে এক মা ছাড়া আর কেউ নাই। সুখে শান্তিতে থাকতে পারব। বাপের এছাড়া উপায়ও ছিলো না। একটা মুখ তো অন্তত কমল। জমি জিরাত বলতে কিছুই নাই। পরের ঘরের বর্গাচাষীদের এতকিছু ভাবলে চলে না। মেয়ে কোন রকমে পাত্রস্থ করাই সেখানে দুরস্ত।

লোকটা আমাকে পছন্দ করত খুব, আমি বুঝতাম। তয় শাশুড়ি ছিল খুব কড়া। তেমন দেখতে পারত না আমাকে। পোলা দখল হওয়ার ভয়ে সবসময়ই চোখে চোখে রাখত, আড়ে আড়ে কথা বলত। স্বামীর বাড়িতে আমি ভালোই ছিলাম। চোখের পলকে দিন যেতে লাগল। বছর না ঘুরতেই পোয়াতি হলাম। বেশি খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যাবে। অবশ্য বেশি খাওন পাবই কই? দিন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ডাক্তার কবিরাজের কথা মুখে আনা বিলাসিতা। শাশুড়ির এক কথা, আমাগোর বাচ্চা কাচ্চা অয় নাই বাপু? তোমার মায়ের তো বছর বছর অইসে। ডাক্তর বাড়িত গেছে কুনোদিন? লোকটা হইসে মা ডরুক। কয় আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক আর হলো কই?

ডেলিভারি দিনের কথা এখনো মনে আছে আমার। আমি তখন দিগ্বিদিক ব্যাথায় কাতর। তিনদিন যাবৎ ব্যাথা, কিন্তু বাচ্চা খালাশের নাম নাই। দাই কিছুক্ষণ পর পর হাত দিয়া পরীক্ষা করে আর বলে, আরেকটু আরেকটু সহ্য কর। মা হওয়া এত সোজা না। মুখ বন্ধ কইরা জোরে কোত দে বইন। বাচ্চা মুখের কাছে আইসা আঁটকায় আছে। মরে যাওয়া এবং বেঁচে থাকার মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আমি তখন। বুঝলাম বাচ্চাটারে টেনে টুনে বের করা হয়েছে। অনেকটা নাকি ছিড়ে গেছে? রক্ত যাচ্ছে বেশুমার! কত বড় বাচ্চা আমার! কত্ত সুন্দর! বাচ্চা আমার কান্দে না! ও বাপ কান্দস না কেন? বাপ আমার! আমার আর কিছু মনে নাই।

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি সব কেমন ঘোলা ঘোলা, শূন্য শূন্য। বাচ্চাটা খুঁজি। কেউই কিছু বলে না। সব কেমন যেনো আবছা অন্ধকারে ডুবে গেছে। পাঁচ ছয়দিন পর আবিষ্কার করি আমার কাপড় চোপড় পানিতে ভেসে যাচ্ছে। প্রস্রাব! আমি প্রানান্তকর চেষ্টা করছি লুকানোর জন্যে। কিন্তু এই জগতে কোটি কোটি মানুষের থাকার জায়গার অভাব না হইলেও আমি একটু লুকানোর জায়গা পাইনা। আমি লজ্জায় ঘৃণায় কুকড়ে যেতে থাকি, বিন্দু থেকে বিন্দু হয়ে
অদৃশ্য হতে থাকি কিন্তু প্রস্রাবের নহর ঠিক আমাকে চিনিয়ে দেয়।

শুনেছি লোকটা নতুন আরেজনকে ঘরে তুলেছে। কাহাতক আর সহ্য করবে? নিজের সন্তান একবার দুইবার বিছানা ভিজালেই অসহ্য লাগে। আর বড় একজন মানুষের সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরলে, এটা সহ্য করা যায়? তবে একটাই কষ্ট, লোকটা একটুও ভাবল না আমার কথা! আমি কই যাবো, কি করবো, কি খাবো? আমারে কাজ দিব কে, খাওয়া দিব কে? আমারে তো কেউ কাজের ঝি হিসাবেও রাখবে না। একজন মানুষের খাওন নাই, পরন নাই, কাম নাই, কাজ নাই, শোয়ার জায়গা নাই, বসার জায়গা নাই, উৎসব নাই, আনন্দ নাই। খালি নাই আর নাই। বিশাল বড় এই জগতে আমার মতো অপাংতেয় একজনও নাই। অথচ বলেন তো এখানে আমার কী দোষ? আমি কী পাপ করেছিলাম। সন্তান ধারণ কি পাপ? একা কী সন্তান ধারণ করা যায়? দুজন মিলে যদি সন্তান হয়, তবে একজন কেনো জীবন্ত দোজখে পঁচে মরবে, আর অন্যজন নতুনে সুখ সাজাবে? আমাকে যদি একটু চেকআপের ব্যবস্থা করতো, অন্ততঃ ডেলিভারিটা যদি হাসপাতালে করাতো তাহলে তো, আমার বাচ্চাটা বেঁচেবর্তে থাকত। আমার এমন প্রস্রাবের রাস্তা, মাসিকের রাস্তা এক হয়ে যেতো না, সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরত না। আপনাদের মাসে পাঁচ ছয়দিন মাসিক হয়, আশি নব্বই মিলিলিটার রক্ত যায়, ভেজা ভেজা লাগে, তাই অস্থির হয়ে পড়েন। আর আমার কথা চিন্তা করেন, প্রতিদিন দুই তিন লিটারের মতো…

জীবনে একবার ডাক্তারের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আকুল হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, আমার কেনো এমন হলো। কী পাপ করেছিলাম আমি? ডাক্তার পরম মায়া নিয়ে বললেন, এই কন্ডিশনকে বলে ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা সংক্ষেপে ভিভিএফ। যেখানে রোগীর প্রস্রাবের থলে ফুঁটো হয়ে অনবরত প্রস্রাব ঝরে। মা, তোমার কোন পাপে এটা হয়নি। পাপ ছিলো অনেকের। তোমার বাবা, মা, স্বামী শাশুড়ি সবার। কেউই তোমার সঠিক যত্নবান ছিল না। অল্প বয়সে বিয়ে, পেলভিস ডেভেলপ হওয়ার আগেই বাচ্চা নেওয়া, কোন রকম চেকআপ না করানো, হাসপাতালে ডেলিভারি না করিয়ে বাসায় অনভিজ্ঞ দাই দিয়ে ডেলিভারি করানো, এসব কিছুই তোমার আজকের অবস্থার জন্য দায়ী।

অনেকেই তো বাসায় ডেলিভারি করায়, তাদের সবারই কি এমন হয়? ডাক্তার বলেন, “না, তা হয় না। যাদের তোমার মতো ছোট বয়সে বিয়ে হয়, কোমরের হাড় ডেভেলপ হওয়ার আগে প্রেগ্ন্যাসি হয়, মায়ের জন্মপথ তুলনামূলক ছোট বিধায় বাচ্চা বের হতে গিয়ে আটকে যায়। প্রসাবের থলের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত ছাড়া উক্ত টিস্যু বেঁচে থাকতে পারেনা, ফলে এক সময়ে নষ্ট হয়ে খসে পড়ে। প্রসাবের থলে ছিদ্র হয়ে যায়। ছিদ্রযুক্ত পাত্রে পানি রাখলে পানি তো ঝরবেই। বেঁচে থাকতে পানি লাগে। সে পানি প্রস্রাব হয়ে প্রস্রাবের থলেতে জমা হয়। সেখান থেকে ওয়াশরুমে। মরার আগ পর্যন্ত এই পাত্রে পানি জমা হবে, আর নিরবধি ঝরে যাবে যদি ছিদ্র বন্ধ করা না যায়।”

হাসপাতালে ডেলিভারি হলে কী এই বিপর্যয় এড়ানো যেতো ডাক্তার আপা?

হ্যাঁ, যেতো। বিপদ আঁচ করতে পারলে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি করা গেলে এবং প্রস্রাবের থলেকে রেষ্ট দেয়া গেলে গল্পটা ভিন্ন হতে পারত। আবার বাচ্চাটাও বেঁচে যেতো।
ইশ, আমি কেনো হাসপাতালে এলাম না? এখন বুঝলাম হাসপাতাল ডেলিভারি কেনো দরকার। সিজারিয়ান ডেলিভারি মানেই খারাপ কিছু না। ক্ষেত্র বিশেষে এটা জীবন বাঁচায়। জীবনকে যাপন যোগ্য রাখে। কেনো যে মানুষ না বুঝে কথা বলে? সিজারের জন্য ডাক্তারকে দোষারোপ করে? কোন বিষয়ে নূন্যতম না জেনে প্রফেশনালদের দোষারোপ করা ঠিক না।

ভেজা জায়গায় কখনো শুয়ে দেখেছেন? কেমন লাগে? প্রতিনিয়ত আমি এমন অবস্থার ভিতর দিয়ে যাই। আমার ঘুম আসে না। কতকাল আমি ঘুমাই না! মানুষ কত কিছু চায়, আমার শুধু একটাই চাওয়া, শুষ্কতা, ড্রাইনেস। আমি শুধুমাত্র একটু শুষ্ক থাকতে চাই। আমার গা থেকে প্রসাবের গন্ধ আসবেনা, আমার বসার জায়গাটা ভিজে যাবেনা, আমার শোয়ার জায়গাটা ভেসে যাবেনা। শীতের রাতে গরম কাঁথার ওমে প্রাণভরে একবার ঘুমাতে চাই। তারপর মরে যাবো, আহ শান্তি! আমার এ চাওয়াটা কি পূরণ হবে না? হবে না ডাক্তার আপা?

আশার কথা হচ্ছে, ডাক্তার আপা বলেছেন, অপারেশন করলে নাকি ভালো হওয়া সম্ভব। যদিও জটিল অপারেশন, সাকসেস রেট কম তারপরও আমি আশায় আছি…

#Lady_in_Red
ডাঃ ছাবিকুন নাহার
Medical Officer,Dhaka Medical College

প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটারঃ জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর

জামিল সিদ্দিকী: A dreamer who want to bring positive changes in health sector in Bangladesh.
Related Post