X
    Categories: ভাবনা

ঘুষ/উপঢৌকন এবং আমাদের ডাক্তারি

লেখকঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান অপু

ডাক্তারদের ঘুষ নেয়া বিষয়ক একটি নিউজ সিরিজ বাংলানিউজ প্রকাশ করেছিল গতবছর(http://bit.ly/1dTuqKj)। সম্ভবত অনেকেই সেটা  পড়েছেন। অনেকের অনেক রকম প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম। বেশিরভাগই ক্রোধান্বিত হয়ে সাংবাদিকদের গালাগাল করে রক্ত মাথায় তুলে ফেলেছেন। এই ব্যাপারে আসুন আমরা আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করি।

১) সারা পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই ওষুধ কম্পানির সরাসরি বিজ্ঞাপন দেয়া নিষিদ্ধ। তাই কোম্পানিগুলো বিকল্প রাস্তা হিসেবে ডিরেক্ট টু কন্সিউমার অথবা ডিরেক্ট টু ফিজিশিয়ান ধরনের মার্কেটিং করে থাকে। এর আওতায় পড়েঃ
*ফ্রি স্যাম্পলঃ নানারকম ওষুধের স্যাম্পল আমরা ডাক্তারেরা এমআরদের কাছ থেকে হরহামেশাই পাই।
*এডুকেশনাল ম্যাটেরিয়ালঃ লিটারেচারও বলা হয়। একপাতা দুই পাতা আকারের রঙ্গিন কাগজ কিংবা ম্যাগাজিনে প্রোডাক্ট এর নানারকম ইনফরমেশন দেয়া থাকে।
*গিফটঃ এর আওতায় কলম, পেন্সিল, প্যাড থেকে শুরু করে মানিব্যাগ, জামাকাপড়, সুই সুতা পর্যন্ত অসংখ্য উপকরন পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পুজা ঈদ ইত্যাদি উতসবে নানারকম গিফট প্যাকেট তো থাকেই।
*ফুড এন্ড ট্যুরঃ সেমিনার হোক কিংবা এম্নিতেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কিংবা বাজারের দু-একটা সিংগাড়া চকলেট চিউইংগাম ইত্যাদি দেয়া হয় কোম্পানির ওষুধ প্রোমোট করতে। আর শীতকালীন গ্রীষ্মকালীন নানা রকম ট্যুর স্পন্সর করা কিংবা দেশের বাইরে অথবা দেশের মধ্যে সায়েন্টেফিক সেমিনার কে সামনে রেখে ভ্রমন এর আয়োজন।
* সায়েন্টিফিক ডিসকাশনঃ সিএমই, বা সেমিনার যে নামেই ডাকি, ডাক্তারদের আলাদা কোন প্রেসেন্টেশন এর শেষে কম্পানির ওষুধের প্রেসেন্টেশন কিংবা শুধু ওদেরই প্রেসেন্টেশন এর জন্য আলাদা সেমিনার দেশে বিদেশে আয়োজন করা হয়।

২) এখন কথা হল এই জিনিসগুলো ডাক্তারদের গ্রহন করা কি বৈধ নাকি অবৈধ?
বাংলাদেশে এই ব্যাপারে স্পষ্ট কোন আইন আছে কিনা আমার জানা নেই। নেটে খুজাখুজি করে কিছু পাইনি। তবে The Pharmaceutical Research and Manufacturers of America (PhRMA) তারা একটা গাইডলাইন বের করেছে কম্পানিগুলোর জন্য সেখানে উপরে যা যা বললাম তার প্রায় সব কিছুই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পূর্নাঙ্গ লিস্ট পেতে এই লিঙ্ক থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে নিন। (http://onphr.ma/10387sb)

৩) বৈধ না অবৈধ সেটা আপাতত সাইডে রেখে আমরা চিন্তা করি ব্যাপারগুলো উচিত নাকি অনুচিতঃ
আমেরিকার THE JOURNAL OF FAMILY PRACTICE তাদের ওয়েবসাইটে কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত প্রকাশ করেছে এই ব্যাপারে সেখানে কি বলেছে চলুন দেখিঃ (মূল লেখা এই লিঙ্কেঃ http://bit.ly/15HJPIh)

*ড্রাগ স্যাম্পলঃ ফ্রি ওষুধ দিচ্ছে আমরা সেটা নিজেরা ব্যাবহার করছি অথবা দরিদ্র রোগীদের দিচ্ছি কিংবা ঐ ওষুধের ব্যাপারে আমরা জানতে পারছি, নতুন নতুন জেনারেশন এর ভাল ওষুধ ব্যাবহার করতে পারছি ইত্যাদি চিন্তা করে ব্যাপারটা ভাল বলে রায় দেয়া যায়। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠ আছে। প্রথমত এমআর রা যেসব স্যাম্পল দিচ্ছেন তার বেশিরভাগই থাকে নিউ জেনারেশন ড্রাগ। পুরনো জেনারেশন এর ড্রাগ খুব কমই দেয়া হয়। ফলে নিউয়ার জেনারেশন ড্রাগ প্রেসক্রাইবড হতে থাকে। এতে অসুবিধা হল এসব ড্রাগ এর দাম সাধারনত বেশি হয়, তাই প্রথম প্রথম ব্যাবহারের পরে অনেকে ডিসকন্টিনিউ করে, দ্রুত ভাল ফল পেয়ে অষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয় কিংবা যে গরীব রোগীকে আপনি তিনদিনের ফ্রি ওষুধ দিলেন সে বাকি ৪ দিন কিনে খেতে পারবে না এটা চিন্তা করা হয় না। ফলশ্রুতিতে ড্রাগ রেজিস্টেন্স তৈরী হতে থাকে মারাত্নক ভাবে। রিজার্ভ ড্রাগ এর সংখ্যাও কমে যায় কেননা সব ওষুধই আমরা ব্যাবহার করে ফেলছি। তাই পুরোনো টেট্রাসাইক্লিন, সালফোনামাইড, এমোক্সিসিলিন এখন আর চলে না, সেফিক্সিম, সেফুরোক্সিম, মেরোপেনাম এর যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। এখন বলুন এই স্যামপ্ল গ্রহন উচিত নাকি অনুচিত?তাছাড়া ফ্রি স্যাম্পল বেচে ডাক্তারেরা মাসে লাখ লাখ টাকা কামায় এরকম কথাও কিন্তু বাজারে প্রচলিত আছে।

*গিফট এবং খাবারঃ আমরা যে গিফট বা খাবার বা বিনোদনমূলক গিফট (ট্যুর, টিকেট ইত্যাদি) নিচ্ছি এই টাকাটা আসলে দিচ্ছে কারা? দিচ্ছে আমরা যাকে ঐ কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করছি সেই পেশেন্ট। তাই নয় কি? আপনি একটি গিফট নিচ্ছেন তার বদলে আপনি সামান্য মাত্রায় (অনেক সময় পূর্ন মাত্রায়) বাধ্য থাকবেন ঐ কোম্পানির ওষুধ লিখতে। সুতরাং আপনার ফ্রি উইল কিংবা রোগীর কস্ট বেনিফিট, লাভ ক্ষতির দাড়িপাল্লা মেপে ওষুধ লেখার যে আদর্শ পদ্ধতি তা অনুসরন করার সুযোগ কি কমে যাচ্ছে না?

*এডুকেশনাল মেটেরিয়ালঃ ওদের দেয়া লিটারেচার এর কথা বলি, সব লিটারেচারেই ঐ ড্রাগ সম্পর্কিত সব রকম ভাল ভাল বয়ান আর জরিপ দেখানো হয়। কখনো ঐ ড্রাগ এর রিস্ক এবং বেনেফিট এর সামঞ্জস্যপূর্ন লিটারেচার দেখেছেন? কিংবা তাদের দেয়া তথ্য আদৌ সঠিক কিনা তাই বা কে যাচাই করছে? মূল আর্টিকেলে এভাবে লেখা হয়েছেঃ “tryer and Bero9 found that 42% of the printed material distributed by drug representatives did not comply with Food and Drug Administration requirements, and 33% did not provide a balanced presentation of the benefits and risks. Ziegler and coworkers10 reported that more than 10% of the information provided by drug representatives was flatly inaccurate.”
নতুন ডাক্তারদের অনেককেই দেখা গেছে প্রাকটিস এর শুরুতে তারা এইসব লিটারেচার ফলো করেই ওষুধ দিচ্ছেন, নতুন নতুন জেনারেশন এর ড্রাগ হয়ত রিস্ক, দাম এইসব না জেনেই লিখে দিচ্ছেন। প্রশ্ন সবার কাছে এইসব ভুল কিংবা বায়াসড এডুকেশনাল মেটেরিয়াল কি আসলেই এডুকেশনাল নাকি আমরা বিজ্ঞাপনের বলি?

*সেমিনার/স্পন্সরঃ থার্ড পার্টি সেমিনার কিংবা অনেক সময় কোম্পানির নিজস্ব সেমিনার, অনেক ভাল ভাল কথা হয় সেখানে। তথ্য আদানপ্রদানের সুযোগ থাকে, ভাল খাওয়া দাওয়া গিফট ও থাকে। খাওয়াদাওয়া গিফট এর কথা আগেই বলেছি। ওদের প্রেসেন্টেশন এর ব্যাপারেও আগেই বলেছি যে তারা বায়াসড ইনফরমেশন দিচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা ডাক্তারদের কোন প্রোগ্রাম তারা স্পন্সর করে অনেকসময় ডাক্তারদের সাথে কিংবা হস্পিটাল এর সাথে সরাসরি চুক্তি করে ফেলে যে আগামী এতদিন আমার অমুক ওষুধ আপনাকে লিখতেই হবে। আমরা কি এই ধরনের সরাসরি ঘুষে অংশগ্রহন করছি না?

*কন্ট্রাক্টঃ প্রাক্টিসিং ডাক্তারদের সাথে অনেক কোম্পানি চুক্তি করে থাকে, বদলে সরাসরি টাকা, কিংবা অন্য ধরনের উপহার এর মাধ্যমে ডাক্তারদের বাউন্ড করে ফেলে, এটাও কি ঘুষ নেয়া নয়?

৩) তো মোটামুটি এই হল অবস্থা। আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে করিতকর্মা সর্বজ্ঞ সাংবাদিক। তারা তিল খুজে পেলে তাল করবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু যদি তালই খুজে পায় তাহলে সেটাকে কাঠাল বানাতে তাদের কি একটুও দেরি হবে? আমরা কি সেই তাল খুজে বের করার উপায় রেখে দিচ্ছি না?  দেখেছি অনেকে বলেছেন ওরা শুধু ডাক্তারদের নিয়ে কেন লিখল কেন ঘুষখোর পুলিশ, সাংবাদিক, উকিল, সরকারি চাকুরে এদের নিয়ে লিখল না। আসলে যার যার পেশার উপর আঘাত আসলে সে ক্ষিপ্ত হয়, এই দিক দিয়ে ডাক্তারেরা সহজ শিকার সাংবাদিকদের কারন আমাদের কমিউনিটি শক্তিশালি নয়। কিন্তু তারা যদি প্রমাণ সহ আমাদের কলঙ্ক উন্মোচন করে তখন আমরা কোন মুখে প্রোটেস্ট করব? আর আমাদের নিয়ে লিখল শুধু অন্যদের নিয়ে লিখল না তাই বলে কি আমাদের অন্যায় মিথ্যা হয়ে গেল? আমরা আশা করব তারা অন্যদের নিয়েও লিখবে। তবে তার আগে আমরা ভাল হচ্ছি না কেন?

৪) নো ফ্রি লাঞ্চঃ আমেরিকার একটি সংগঠন, প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। বেশিরভাগ ডাক্তারসহ, কিছু নার্স, মেডিকেল এসিস্টেন্ট এবং ফার্মাসিস্ট নিয়ে প্রায় ৫০০ এর বেশি মেম্বারের একটি সংগঠন যারা শপথ করেছে যে তারা ফার্মেসি কম্পানিগুলোর কাছ থেকে কোন খাবার তো দুরের কথা একটা কলম ও নেবে না। তাদের শপথ ঃ “accept no money, gifts, or hospitality from the pharmaceutical industry; to seek unbiased sources of information and not rely on information disseminated by drug companies; and to avoid conflicts of interest in [their] practice, teaching, and/or research.”
তারা এমনকি কোম্পানি ফান্ডেড সেমিনার এরও বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে এইরকম একটি সংস্থা গঠন করা, তাদের শপথ এর মত করে আমাদের দেশের উপযোগী এরকম একটা উদ্যোগ কি আমরা নিতে পারি না?”

ডক্টরস ডেস্ক: bddoctorsplatform@gmail.com

View Comments (4)

  • Thank you for your valuable opinion...I want to add that medicine cost will reduce if we avoid such type of illegal benifit from the company.

  • আমি অজনপ্রিয় ইন্টার্ন এবং ডাক্তার ছিলাম কমপ্লাই না করার কারনে। আমারে যতই দিক ঔষধ আমার মত। পরে পরে নাম হয়ে গেল, লাভ নাই, খায় না। আমার আশেপাশেও আর কেউ আসেনা। পুওর ফান্ড ও ভরে না।
    বাই দা ওয়ে, ভিপিএন ছাড়া পেইজটা অন হল না। সবাই একটু চেক করে দেখ যার যার আই এস পি।

Related Post