X

ক্যান্সারের কথন: “ভিটেটা যদি বাঁচানো যেত”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, শনিবার

ডা. নূর ইসরাত
ICU MO, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল
Resident, Medical oncology, NICRH

ছবির হেডিং দেখে মনটা ভরে গেল। ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে রংপুর ক্যান্সার হাসপাতাল।

ভাল লাগাটা যে একজন ভবিষ্যৎ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে তা তো বটেই। এর চেয়ে বেশি এ কারণে যে হয়ত উত্তরবঙ্গের কিছু দরিদ্র ক্যান্সার রোগীর ভিটেটা বেঁচে যাবে।

এরকম একটা অনুভূতি আসার পেছনের গল্পগুলো অনেক বড়। ২০১৬ সাল থেকে যখন পরিবারের একজন ক্যান্সার চিকিৎসার সাথে যুক্ত হয়েছিল তখনের। গল্পগুলো শুনেছি দূর থেকে।
এরপর নিজে ২০১৮ তে ক্যান্সারের একটা ব্রাঞ্চে কাজ শুরু করলাম। দূর থেকে শোনা গল্প গুলো শুনি একদম কাছ থেকে। ১ দিন, ২ দিন করে এভাবে ৩ মাস। সবার গল্পের সারমর্ম একটাই। ছলছল চোখে বলছে, “ম্যাডাম প্রায় সব শেষ। ভিটেটা শুধু আছে।”

মেডিকেল অনকোলজিতে আমার ৩ মাসের ব্লক শেষের পর মেডিসিনের অন্যান্য ব্লক গুলোতে ঢাকার বাকি তিনটা জাতীয় ইন্সটিটিউট ও BSMMU তে কাজ করেছি। সেখানেও এরকম অনেক গল্প। হয়ত কোনটার মাত্রা কম, কোনটার বেশি।

এভাবে ৭ টা ব্লক করার পর ডিপার্টমেন্টের কাজ ছাড়া NICRH যাওয়া হত না। সে গল্পগুলো শোনা হত না কাছ থেকে। এরপর বিসিএসে পোস্টিং হয় পাশের দেশ ভারতের বর্ডার ঘেষা জেলা পঞ্চগড়।
কিছুটা কষ্ট হলেও জীবনের এ বৈচিত্র্যগুলো থেকে উপলব্ধি করেছি অনেক। জীবন থেকে নেয়ার মত শিখেছি একদম আনাড়ি হয়ে।

মার্চ থেকে করোনা আসার পর সব বর্ডার বন্ধ হল আস্তে আস্তে। বর্ডার পেরিয়ে পাশের দেশের বর্ডার ঘেষা জেলায় অটোতে করে হাসপাতালে যাওয়া রোগী গুলো যেন নিজেদের মাঝ নদীতে বৈঠাহীন মাঝির মত মনে করতে লাগল।
কোথায় যাবে? কিভাবে যাবে?
কারন ক্যান্সার রোগের লক্ষ্মণ আর যন্ত্রণা তো বোঝে না পৃথিবীতে করোনা নামক এক অনুজীব এসে সব কিছু স্থবির করে দিয়েছে।

আবার তাদের তো সেই টাকাও নেই যে মাইক্রো ভাড়া করে রংপুর মেডিকেল বা ১২ ঘন্টা জার্নি করে ২২ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ঢাকা আসবে।

তাই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হয়েছিল সেই পাশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
কেউ আসছে কমে যাওয়া হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য রক্ত দিতে। কেউবা অসহ্য হাড় মেটাস্টাসিস এর ব্যাথা সইতে না পেরে।
কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র বা পাশের দেশের ছোট ছোট হরফে টাইপ করা কাগজ গুলো দেখলেই ইমার্জেন্সি স্টাফরা বলে, “হবে না এখানে।”
উপজেলা লেভেলে ক্যান্সার চিকিৎসাপত্রে হাত না দেওয়া হয়তো স্বাভাবিক।

স্টাফরা আগেই বলে দিচ্ছে রংপুর যান নয়ত ঢাকা যান। তখন রোগীর লোকের সেই একই কথা, “সব শেষ ভাড়া নাই। একটু ব্যথা কমানোর ঔষধ দেয়া যায় না? নাভিতে এই ইনজেকশনটা দেয়া যায় না?”
স্টাফগুলো বলছে, “এখানে ক্যান্সার চিকিৎসা হবে কেমনে?”

সব গুলো কথোপকথন শুনছি আমি ভেতরের রুম থেকে। ওয়ার্ডবয়কে বললাম, “রোগীকে ডাকেন। কাগজ আনেন।”

NICRH এ কাজ করায় কিছুটা তো ধারণা আছে। দেখলাম কেমোর কোন এক সাইকেল শেষ হয়েছে। এরপর নাভির গোড়ায় একটা স্টিমোলেটিং ফেক্টর দেয়ার জন্য তারা এসেছে। কথিত সে হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে তোমার পাশের হাসপাতালে গেলেই দিয়ে দিবে।
কিন্তু ইমার্জেন্সি স্টাফরা এ ঔষধ দেখে কেমো ভেবে আমাকে না জানিয়েই রোগীকে বিদায় দিচ্ছে।

তারপর রোগীকে সেই চামড়ার নিচে দেয়ার ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। রোগীর অবস্থা বললাম লোকের কাছে আলাদা করে যে শেষ অবস্থার দিকে।

তারা অনেক কৃতজ্ঞতা দেখাল।
যাওয়ার সময় আমাকে ৫০ টাকা দেওয়ার জন্য রোগীর কিষাণী বউকে বলছে। সে চোখ মুছতে মুছতে শাড়ির আঁচল থেকে ৫০ টাকা বের করে দিয়ে ভারী কন্ঠে বলছে, “ম্যাডাম সব শেষ পাশের দেশে গিয়ে। এখন ভিটেটা আছে শুধু।”

ততক্ষণে আমার চোখের সামনে ঝাপসা লাগায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সংযত করে বল্লাম, “৫০ টাকা লাগে না এ হাসপাতালে। আপনি ৩ টাকা দিয়ে টিকেট কাটেন। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি।”

করোনা কালে আমার ডিউটিকালীন প্রতিটি ইমার্জেন্সিতে আমি এরকম শুধু ভিটে আছে সব শেষ হওয়ার ২/১টি গল্পের সাক্ষী হয়েছি। জানিনা বাকিদের কেমন ছিল।

মনটা খুব খারাপ হতো রোগী গুলো চলে গেলে।
তাদের ক্যান্সার এজন্য যতটা না খারাপ লাগত এর চেয়ে বেশি লাগত তাদের সব হারানোর গল্প শুনে।

উত্তরবঙ্গে ক্যান্সার হাসপাতাল হওয়া দরকার খুব দ্রুত। নয়তো কৃষিপ্রধান এ এলাকার হাজার হাজার কৃষকের ভিটে বিক্রির টাকাটা চলে যাবে বর্ডারের ঐ পাড়ে।

Mosrat Moontaha Shamsi:
Related Post