X

করোনা মহামারীর নতুন এপিসেন্টার দক্ষিণ এশিয়া

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

সেই ২০২০ এর জানুয়ারী থেকে শুরু করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব, কমার কোন লক্ষণ নেই! চীন থেকে শুরু করে, ইউরোপ আমেরিকা হয়ে এখন সে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়াতে। ভারতে বসিয়েছে ভয়ংকর থাবা। আমরা বাংলাদেশীরা এখনও করোনার ভয়ংকর রূপ দেখিনি! দেখেছে ইউরোপ, দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী আগানো দেশগুলো কিভাবেই না ধরাশায়ী হয়েছে- ন্যানোমিটার সাইজের অতি ক্ষুদ্র এই ভাইরাসটির কাছে।

গতকালও যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মারা গেছে বারো শ এর উপরে। ৩৩ কোটি লোকের এই দেশটিতে গত পাঁচ মাসে এ পর্যন্ত প্রান গেছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের। পৃথিবীর আর কোন দেশে এখন পর্যন্ত এত লোক মারা যায়নি এই মহামারীতে। ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয় ৩ লক্ষ লোক, যার মধ্যে মারা যায় প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ। বিশ্বে যেখানে করোনায় গড় মৃত্যুহার শতকরা ৪ ভাগ, সেখানে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুহার শতকরা ১৫ ভাগ! যে দেশে রয়েছে বিশ্বখ্যাত সব গবেষণাকেন্দ্র, এনএইচএস এর মত নামকরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সে দেশের কী হাল এই মহামারীতে! গত এক মাস হল এখানে করোনার প্রকোপ কিছুটা কম। কিন্ত গত এক সপ্তাহে করোনা রোগীর সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, আগামী দুই সপ্তাহের ভেতরে করোনা মহামারীর সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হতে পারে। এটা আসলেই আশংকাজনক। জুলাইয়ের ৪ তারিখ থেকে যুক্তরাজ্যে লক- ডাউন শিথিল করা হয়েছে, খুলে দেয়া হয়েছে সবকিছু। ব্রিটিশরা মু্ক্ত ভাবে চলাফেরা শুরু করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে হলিডে করতে। আর সেখান থেকেই ফেরার পথে সাথে করে নিয়ে আসছে করোনা ভাইরাস! স্পেনে সম্ভবত মহামারীর সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহে সেখানে করোনা রোগী বেড়েছে সমানুপাতিক হারে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রিটিশরা স্পেন থেকেই নতুন করে সংক্রমিত হয়েছে।

বাংলাদেশে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছে ২ লক্ষ ২৯ হাজার মানুষ, যার ভেতরে মারা গেছে মোট ৩ হাজার। মৃত্যুহার মাত্র শতকরা ১.৩ ভাগ, যা ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। এই কম মৃত্যুহারের কারণেই হয়তো ইদানীং আমাদের ভেতরে একটা চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। আমরা মাস্ক ছাড়া মুক্ত ভাবে চলাফেরা শুরু করেছি। সামাজিক দূরত্বের থোরাই কেয়ার করছি! করোনা ভীতি আমাদের মাঝ থেকে উঠে গেছে হঠাৎ করেই! বাংলাদেশে করোনা টেস্টের নামে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং বিশৃঙ্খলা। সাম্প্রতিক জিকেজি, রিজেন্ট হাসপাতাল, শাহেদ করিম বা ডা. সাবরিনার কাহিনীগুলো সম্ভবত করোনা টেস্টের দুর্নীতির ‘টিপ অব দ্যা আইসবার্গ, মাত্র! মহামারীর ভেতরও এই রকম দুর্নীতি নজিরবিহীন। এছাড়াও বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে নামে মাত্র। ১৬ কোটি মানুষের দেশে দৈনিক টেস্ট করা হচ্ছে ১০-১২ হাজার। যেখানে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র করোনা টেস্ট করছে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষে যথাক্রমে ২ লক্ষ ২৩ হাজার ও ১ লক্ষ ৭০ হাজার, সেখানে বাংলাদেশে টেস্ট করা হচ্ছে প্রতি ১০ লক্ষে মাত্র ৭ হাজার! ৭ কোটি লোকের দেশ যুক্তরাজ্যে যেখানে মোট টেস্ট করা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লক্ষ, সেখানে ১৬ কোটির দেশ বাংলাদেশে মোট চেস্ট করা হয়েছে ১১ লক্ষ ৩০ হাজার! মহামারীর প্রকোপ বোঝার জন্য এই টেস্ট খুবই অপ্রতুল। ধরে নিলাম যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মত এত টেস্ট করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। যা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের উচিত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তুলনা করা। অর্থনৈতিক এবং ভৌগলিক দিক দিয়ে ভারতের সাথেই বাংলাদেশের তুলনা করাটা যথার্থ এবং সমীচীন। ১৩৮ কোটি লোকের দেশ ভারতে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫ লক্ষ মানুষ, আর মারা গেছে ৩৪ হাজারের উপরে। সেই হিসেবে মৃত্যুহার শতকরা ২.২ ভাগ। অনেকটা বাংলাদেশ এর কাছাকাছি। ভারত প্রতি ১০ লক্ষে টেস্ট করছে ১২ হাজার ৫০০। আর আমরা টেস্ট করছি প্রায় এর অর্ধেক! কেন? জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে প্রায় ৯ গুন বড় ভারত যদি ১২ হাজার টেস্ট করতে পারে ১০ লক্ষে, তাহলে আমরা কেন পারবো না, অন্তত তাদের সমান সংখ্যক টেস্ট করতে? মোট টেস্টের বিচারে ভারত আমাদের চেয়ে ১৫ গুন বেশি টেস্ট করেছে। আমাদেরকে অবশ্যই টেস্ট সংখ্যা বাড়াতে হবে কয়েক গুন এবং সেটা করতে হবে অতি দ্রুত। এটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, করোনা মহামারীর নতুন এপিসেন্টার হতে যাচ্ছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া। আর এ অঞ্চলে ভারত সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত দেশ। আর আমরা রয়েছি ভারতের একদম পেট ঘেঁষে। এ কারণেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে অনেক বেশী। মহামারীর শুরুতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুব খারাপ, তখন তার বর্ডার ঘেঁষা থাকা মেক্সিকোর অবস্থা ছিল খুবই ভাল। আর এখন মেক্সিকোর কি অবস্থা! ৪ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত এবং মারা গেছে ৪৪ হাজার। মেক্সিকোর অবস্থা ভাল থেকে খারাপ হতে সময় লেগেছে মাত্র ২ মাস! আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, তাহলে আমাদের আবস্থা যে ভারতের মত হবে না, তা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না। করোনাভাইরাস একটি বিশ্বাসঘাতক জীবাণু। একে না বিশ্বাস করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সরকার কি করলো বা না করলো, সেদিকে না তাকিয়ে নিজে সতর্ক হন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। অবশ্যই মাস্ক পরে বাইরে বের হন। বাইরে থেকে এসে পরিধেয় বস্ত্র এবং জুতা আলাদা রাখুন এবং নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।

তথ্য: ওয়ার্ল্ডোমিটার

Silvia Mim:
Related Post