X

ইন্টার্নশিপঃ টিকে থাকা বনাম এগিয়ে যাওয়ার লড়াই

ইন্টার্নশিপঃ টিকে থাকা বনাম এগিয়ে যাওয়ার লড়াই।

চিকিৎসক হিসেবে আপনি কতটা সফল হবেন, বড় ডাক্তার হবেন না বড়লোক ডাক্তার হবেন, মানুষ হিসেবে কতটা ভালো হবেন-ইন্টার্নশিপের এক বছর ঠিক করে দেবে আপনার ভবিষ্যত। বইয়ের পাতা থেকে হাতে কলমে ডাক্তারি বিদ্যার দক্ষতা, ক্যারিয়ার হিসেবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বিষয় বেছে নেয়া, বিসিএসের প্রস্তুতি, জীবনে প্রথম বারের মত নিজের খরচ চালিয়ে টানাটানির সংসারে অল্পস্বল্প কন্ট্রিবিউশন, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আর ক’টা দিন সময় চেয়ে নেয়া-আর হ্যাঁ প্রতিদিন প্রতি ওয়ার্ডে সিনিয়র কলিগ ও রোগীর সাথে মানিয়ে নেয়ার নাম ইন্টার্নশিপ।

এ বছর যে ব্যাচটা ইন্টার্নশিপ শুরু করলো তাঁদের প্রথম মাস চলছে। আমার নিজের ইন্টার্নশিপ শেষ হলো সাড়ে তিন বছর হয়। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে কয়েকজন নতুন ইন্টার্নশিপে জয়েন করা চিকিৎসকের সাথে আলাপ হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। সে কথোপকথনই এখানে লিখছি, কিছু সুখ স্মৃতি, কিছুটা পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ রিলে রেসের মত বাটন তুলে দেয়া, কিছু ট্রিকস ও টিপসের জন্য এ লেখা।

ইন্টার্নশিপের প্রথম দিনগুলো গল্পের মত। ডিউটি শেষে রুমে গিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত রুমমেট বা বন্ধুদের আড্ডায় “আজকে ১৩ নাম্বার ওয়ার্ডে কি হইছে জানিস…” না বলা পর্যন্ত শান্তি লাগে না। মোটাদাগে ইন্টার্নশিপের এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখবো,

১ ওয়ার্ড ডিউটিঃ ডিউটি রোস্টার নিয়ে কাড়াকাড়ি, সিনিয়রদের গাইডেন্স, রাউন্ডে ঝাড়ি, নার্স-ওয়ার্ড বয়-আয়া অন্য স্টাফদের সাথে ইন্টারেকশন(দিদি বলা যাবে না, সিস্টার এক্স নামে ডাকতে হবে। একই ভাবে ওয়ার্ড বয়কে ভাই/মামা অথবা তুই তোকারি করা যাবে না), অন কল, রেফারেল ইত্যাদি এটেন্ড করা। কিছু শব্দের মানে জানা, NOD, POD, NPO, সেকেন্ডারি, রিস্ক বন্ড।

২ রোগী ম্যানেজ করাঃ রিসিভ করা(এটাই মূল চ্যালেঞ্জ। ট্রিটমেন্ট কি হবে, ওষুধের ট্রেড নেম জেনেরিক নেম নিয়ে প্যাঁচ), ফলো আপ, ডিসচার্জ, রোগীর এটেন্ডেন্ট সামলানো, ওটির জন্য রোগী রেডি করা, কনসেন্ট লেখা, ডেথ ডিক্লেয়ার করা।

৩ ক্লিনিক্যাল স্কিলঃ ক্যানুলা(এ কাজে লেবার রুম সব চেয়ে ভালো কারণ লেবার পেইন এত তীব্র হয় আপনি ক্যানুলা করতে গিয়ে ব্যথা দিলেও সেটা কমই মনে হবে), এনজি টিউব, ক্যাথেটার, স্টিচ(ক্যাসুয়ালটি, নিউরো সার্জারিতে সুযোগ বেশি), ওটি এসিস্ট, কেমোথেরাপি দেয়া, অন্যান্য প্রসিডিউরঃ প্লুরাল ফ্লুইড-এসাইটিক ফ্লুইড এসপিরেশন, লাম্বার পাংচার, সিপিআর-আম্বু ব্যাগ, অপথালমোস্কোপি, ইন্টারকোস্টাল চেস্ট ড্রেইন টিউব, সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টোমি, প্ল্যাস্টার, ব্যান্ডেজ, ড্রেসিং। সারকামসিশন ক্যাম্প, আই ক্যাম্পে যোগদান। সিপিআর কোর্স।

৪ ডকুমেন্টেশনঃ এডমিশন টিকিটে রোগীর ইতিহাস লেখা, ফলোয়াপ লেখা(SOAP Note: Subjective, Objective, Assesment, Plan), রেফারেল/অন কল লেখা, ইনভেস্টিগেশন প্রোফাইল তৈরি, হ্যান্ড ওভার খাতা, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট, ডেথ সার্টিফিকেট, মর্নিং সেশনে কেস প্রেসেন্টেশন, আপডেটেড লগবুক।

৫ ক্যারিয়ার চয়েজ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন-বিসিএসের প্রস্তুতি। ক্লিনিক ডিউটি, খ্যাপ-টাকা জমানো।

৬ ওষুধ কোম্পানির এমআর, স্যাম্পল, গিফট, রিসিপশন। গিফটের ব্যাপারে বেশ কয়েক ধরনের বক্তব্য আছে, তবে অধিকাংশই সকল ধরনের গিফট নেয়া অনুচিত(কিন্তু আমার নিজেরই প্যাড কলমের ব্যপারে ফ্যাসিনেশন আছে)।

৭ টেক এ ব্রেক, ট্রিট, ট্যুর।

৮ অন্যান্যঃ ফার্স্ট ইম্প্রেশন গেট আপ, নন ভার্বাল কম্যুনিকেশন, পেশেন্ট রেস্পনসিভনেস ইত্যাদি।

এক লেখায় এতগুলো দিক তুলে আনা কঠিন। এ লেখার রেস্পন্স, সময় সুযোগ পেলে হয়ত প্রত্যেকটা পয়েন্ট নিয়ে সিরিজ লেখা যেতে পারে। কয়েকটা বিষয়ে খেয়াল রাখতে পারেনঃ

১ রোগী এসে কখনোই বলবে না আমার হার্ট এটাক হয়েছে, সে বলবে বুকে ব্যথা, দম ছাড়তে কষ্ট হয়। বাকিটুকু আপনি জানেন। কিন্তু ঝামেলা হয় যখন পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় না। চটগ্রাম, সিলেট অঞ্চলের মানুষের ভাষা এমনিতেই দূর্বোধ্য, এক্ষেত্রে লোকাল ভাষায় কিছু চিফ কমপ্লেইন জেনে রাখা যেতে পারে।

২ পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের একটু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মব ম্যানেজমেন্ট মানে রোগীর সাথে আসা একদল এটেন্ডেন্ট ম্যানেজমেন্ট। রোগী রিসিভের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ, প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক যেমন ক্যানুলা-মাইক্রোপোর-ইনফিউশন সেট আনতে দেয়া, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে দেয়া, ক্ষেত্র বিশেষ রক্ত ম্যানেজ করা অন্যান্য কাজ করতে হয়। যে রোগীর সাথে যত মানুষ আসবে প্রত্যেক কে আলাদা আলাদা ভাবে এগুলো আনতে দিতে হবে। এতে রোগীর এটেন্ডেন্ট নিজেকে ইনভল্ভ বেশি মনে করবে, রোগীর সুস্থতা ভালো মন্দের সাথে যে নিজেরাও দায়ী সেটা মনে করবে। একজন শিক্ষানবিস চিকিৎসক কে প্রতিটি ভিন্ন ওয়ার্ডের জন্য প্রত্যেক সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে এ তিনটি জিনিস জানতে হবেঃ প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ফাইলে ট্রিটমেন্ট, কি কি আনুষঙ্গিক ও ওষুধ, কি কি পরীক্ষা দিতে হবে।

৩ হাসপাতালে মানুষ সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আসে। সম্ভব হলে রোগীর বর্তমান অবস্থা,রোগীর প্রগনসিস(মানে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে কিনা), রোগ-পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে অন্তত দু একটা ব্যখ্যামূলক কথা বলতে হবে। সিম্প্যাথি না দেখাই অন্তত রোগীর এ অবস্থার জন্য আপনিও দুঃখিত এটা অন্তত রোগীর এটেণ্ডেন্ট কে বুঝতে দিতে হবে সেটা আপনি যত ব্যস্ততই থাকুন। কিছু নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের ভর্তি রোগী কখনো ভালো আছে, মৃত্যুর আশংকা নেই বলা যাবে না যেমনঃ নব জাতক ও শিশু ওয়ার্ডে কোন রোগী ভালো আছে বলা যাবে না যে কোন সময় খারাপ হতে পারে। ভিআইপি রোগী বুঝতে পারলে সেরকম ব্যবস্থা আগে থেকেই নেয়া।

৪ রাউন্ডের ঝাড়ি থেকে বাঁচতে দুটো কাজ করতে পারেন, প্রথমত কেস প্রেসেন্ট করেই স্যারকে/সিনিয়রকে সেই কেসটা নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা(যেটার উত্তর আপনি জানেন/অথবা উত্তর সময় সাপেক্ষ)। দ্বিতীয়ত, আপনাকে কি প্রশ্ন করা হবে আগে থেকে আন্দাজ করা(এটা একটু কঠিন হবে তবে অসম্ভব নয় যেমনঃ ইসিজি ইন্টারপ্রিটেশন, এক্সরে ফাইন্ডিং, আইসিইউ তে ব্লাড গ্যাস এনালাইসিস, বিপিএইচের রোগীকে ডিআরই ফাউন্ডিং, পোস্ট অপারেটীভে ইনপুট আউটপুট চার্ট।

৫ সব সময় পকেটে একটা স্লিপ প্যাড রাখবেন। সেখানে আপনার বেডের পেশেন্টের দরকারী তথ্য থেকে শুরু করে ঐ ওয়ার্ডে যে সব কেস কমনলি আসে তার ম্যানেজমেন্ট, নতুন কোন ড্রাগের ট্রেড নেম ও ব্যবহার শিখলে সেটা, রাউন্ডে অবশ্যই স্যার বা সিনিয়র কলিগ আপনার অন্য কলিগকে বলবে-“ছি ছি তুমি এটা পারো না, আমার দেখা সব চেয়ে বাজে ব্যাচ তোমরা”। যে বিষয়টি না পারার জন্য এই বকা খেতে হলো আপনি নিশ্চিত থাকেন পড়ে এই কেসটাই আপনার বেডে আসবে।

ফ্রেন্ড লিস্টে ইন্টার্নশিপের সময়ের মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক্সের যে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক স্যারদের অধীনে ট্রেনিং করেছি তাঁরা আছেন, সার্জারির সিএ, আইএমও, সিনিয়র এইচএমও রা আছেন। এক ধরনের ধৃষ্টতা এ ধরনের লেখা, বিশেষ করে আমার ব্যাচমেটরা হয়ত হাসাহাসি করে করছে কারণ আমি নিজেই হাতের কাজে খুব বাজে ছিলাম। তবুও এর মাধ্যমে যদি জুনিয়র কারো জড়তা, দ্বিধা, ভয় কাটে, উপকারে আসে সে জন্য একটু চেষ্টা করলাম মাত্র। আপনাদের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হলে সবগুলো পয়েন্ট নিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীতে তুলে ধরতে পারি।

ডক্টরস ডেস্ক: bddoctorsplatform@gmail.com
Related Post