X

“আশাবাদী হতে দোষ কোথায়! “

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, মঙ্গলবার, ২৫মে, ২০২১

ডা. ইমরুল কায়েস
সার্জিকাল রেজিস্ট্রার
রয়াল ইনফার্মারি হসপিটাল
ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস, যুক্তরাজ্য

বেশ কিছুদিন আগে, আমার পরিচিত এক জুনিয়র ডাক্তারের বাবার চেস্ট এক্সরে করে তার লাংসের নীচের দিকে একটা সন্দেহজনক ছোট্ট শ্যাডো পাওয়া গেলো, এক্সরে দেখে যেটাকে হুট করে কোন কিছু বলে ডায়াগনোসিস করা যাচ্ছেনা।

সিটি স্ক্যান করে, আরো কিছু পরীক্ষা করে মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত হওয়া গেলো ফুসফুসের ক্যান্সার।

মোটামুটি বলছি কারন তখনও বায়োপসি নেয়া হয়নাই। বায়োপসি ছাড়া আপনি এক বাক্যে কোন কিছুকে ক্যান্সার বলতে পারেন না, সেটা যে ক্যান্সার না, সেটাও জোর দিয়ে বলতে পারেন না।

লম্বা একটা সুঁই দিয়ে ফুসফুসের গহীন থেকে বায়োপসি নেয়া হলো। পিইটি স্ক্যান করা হলো (বিশেষ ডাই দিয়ে করা সিটি স্ক্যান। শরীরের আরো কোথাও ক্যান্সারটা ছড়িয়ে পড়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য এই স্ক্যানটা করা হয়।)

ক্যান্সার ডায়গনসিস করা হলো, ক্যান্সারের পাশে দুটো সাসপিশাস লিম্ফনোডও পাওয়া গেলো!(মেডিকেলের বাইরের কাউকে লিম্ফ নোড ব্যাপারটা বোঝানো একটু জটিল হয়ে যায়। আপনার ওয়াইল্ডেস্ট ইমাজিনেশন দিয়ে কল্পনা করে নিতে পারেন, লিম্ফনোড হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বলের মতন বস্তু, যারা বেসিক্যালি বিভিন্ন অর্গানের আশেপাশে থাকে। এবং অর্গান এবং টিস্যুর এক্সট্রা ফ্লুইড গুলো ক্যারি করে নিয়ে যায় এবং ইমিউনিটিতেও হেল্প করে।)

তারপর রোগীর লোক মানে আমার জুনিয়র ডাক্তার আমাকে জানালো,”কাকে দেখানো যায়?”
আমি একটু বিপদে পড়লাম।আসলেই কাকে দেখানো যায়? আমি তো ব্যক্তিগত ভাবে কোনো থোরাসিক সার্জনকে চিনিনা! এদিক সেদিক জিজ্ঞেস করেও কোন সন্তোষজনক রিকমেন্ডেশন পেলাম না।

ক্যান্সারের রোগী দেরিও তো করা যায়না! ওরা নিজেরাই ঢাকার এক স্বনামধন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আমার গিল্ট ফিলিংসটা কমালো।

যাই হোক, ভর্তি হওয়ার তিন দিন পরেই সার্জারি হয়ে গেল।

সার্জন জানালেন, খুব ভালো অপারেশন হয়েছে, ক্যান্সারের অংশটা হেলথি মার্জিন সহ কেটে, ল্যাবে হিস্টোলজি পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়া গেছে।

আমার জুনিয়র ডক্টর জিজ্ঞেস করলো, “লিম্ফনোডস গুলো স্যার?” স্যার বললেন, “সব ক্লিয়ার করা হয়েছে। নো টেনশন।”

“তারপর স্যার?”
“তোমরা একজন ভালো অনকোলোজিস্ট এর সাথে কথা বলো।” উনি কেমোর ব্যাপারে কি বলে দেখো। ঐভাবে শিডিউল নাও।

কিছুদিন পর হিস্টোলজি পরীক্ষার রেজাল্ট আসলো।
লাং ক্যান্সারের অংশ আসলেই ভালো মতন কেটে ফেলা গেছে। নো মার্জিন ইনভলমেন্ট। মুশকিল হচ্ছে, লিম্ফনোড নিয়ে কিচ্ছু লেখা নাই।

আমার ছোটভাইটা দৌড়ে গেলো ল্যাবে। “আপনারা লিম্ফনোডের ব্যাপারে কিছু জানান নাই কেন? ”
ল্যাব থেকে বললো, “রিসেকটেড স্পেসিমেনে লিম্ফনোড তো ছিলইনা!”

ছোটভাই দৌড়ালো সার্জনের কাছে!
সার্জন বিরস মুখ করে জানালো, “যতটুকু পারা যায় কেটেছি। লিম্ফ নোড ঐভাবে আনা যায়নাই!”

আমার ছোটভাই এর মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো!তাহলে স্যার!

“অসুবিধা নাই, ঐগুলো রিএকটিভ লিম্ফনোড। মেটাস্টেসিস না। চিন্তার কিছু নাই। তুমি কেমোর ব্যবস্থা করো!”

মাস দুই এক বাদেই আঙ্কেলে শরীর খারাপ হতে শুরু করলো!
পরীক্ষা করে টরে দেখা গেলো, ভদ্রলোকের ক্যান্সার শরীরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে গেছে।

এন্ড অব দ্য লং বোরিং স্টোরি।

আমি নিজে ডাক্তার৷
বাংলাদেশের প্রায় সকল লেভেলে আমি ডাক্তারি করেছি। আমি অনারারি ট্রেইনিং করেছি। উপজেলা, সদর হাসপাতালে সরকারী চাকরি করেছি। ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি, সার্জারি ডিপার্টমেন্টে পোস্টেড হয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি।

এই বছর খানেক ধরে ইংল্যান্ডের হাসপাতালে কাজ করছি।

আমার অভিজ্ঞতা, ডাক্তার হিসেবে এই পুরো ঘটনাটার কিছু ইনসাইট দিই আপনাদের।

দেখেন, ক্যান্সার রোগীর এমন ভাবে চিকিৎসা দুনিয়ার কোথাও হয়না।

সভ্য দেশে প্রত্যেক ক্যান্সার রোগীকে একটা এমডিটি মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। মানে, একটা মিটিং এ সার্জন, অনকোলজিস্ট, রেডিওলোজিস্ট, প্যাথলজিস্ট সবাই বসে রোগীর বেস্ট পসিবল ট্রিটমেন্টটা নিশ্চিত করে।

হুট করে একজন সার্জন নিজেই সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। এইটাতো একটা মানুষের জীবন মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত!

রোগীকে কেন খুঁজে খুঁজে অনকোলোজিস্ট বের করতে হবে?
রোগীকে কেন জিজ্ঞেস করতে হবে লিম্ফনোড কই!

রোগী এবং রোগীর লোককে যে কোনো রকম তথ্য গোপন করার এই ঘটনা দুনিয়ার কোথাও আপনি দেখবেন না!

এই একটা ঘটনায় একটা পরিবার যে এলোমেলো হয়ে গেলো! আজীবনের জন্য একটা তীব্র শোক যে নেমে এলো কয়েকটা মানুষের জীবনে এর দায় কে নেবে!

ডাক্তারি কি এইরকম ক্যাজুয়াল একটা প্রফেশন!

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই বেসিক পরিবর্তনগুলো দরকার।

প্রত্যেক হাসপাতালে (সরকারি, বেসরকারি, ক্লিনিক, প্রাইভেট প্র‍্যাকটিস যাই হোক) ক্যান্সার রোগীর এমডিটির ব্যবস্থা থাকতেই হবে। প্রত্যেক ক্যান্সার রোগীকে নিয়ে সকল এক্সপার্ট মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হিবে এবং সে তথ্য জমা রাখার জন্য একটা ন্যাশনাল ডাটা বেইজ লাগবে।

জবাবদিহিতা লাগবে।

একটা মানু্ষের জীবন তো আপনার ক্যাজুয়াল চরিত্র, আপনার ইগো, আপনার ইগনোরেন্সের উপর নির্ভর করতে পারেনা!

সকল ক্যান্সার রোগীর একই চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সকল ক্যান্সারের স্টেজ অনুযায়ী ন্যাশনাল প্রটোকল বানানো থাকবে। দেশব্যাপি সে প্রটোকলের ব্যবহার নিশ্চিত করত হবে।

আপনি জামালপুরে যে চিকিৎসা পাবেন, ঢাকার একটা হাসপাতালেও যেন আপনি সেই চিকিৎসা পান। লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকলে আপনি রোগী রেফার করবেন। কিন্তু প্রোটকল থেকে সরে নিজের মতন চিকিৎসা করা যাবেনা।

ভালো ডাক্তার, লিজেন্ড এসব একটা দেশে কেন থাকবে!
আমাদের সিস্টেমটাই এমন হবে, রোগীকে ভালো ডাক্তার খুঁজতে বের হতে হবেনা।

সকল হাসপাতালে, সকল ডাক্তার তার একই রকম চিকিৎসা করবে।

তাকে চিকিৎসা করবে একটা মানসম্পন্ন, সেন্সেটিভ, লজিক্যাল, জবাবদিহি মূলক আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,
আলাদা করে ডাক্তার চেনার তার প্রয়োজনই হবেনা।

উদাহরণটা ক্যান্সার পেশেন্ট দিয়ে দিলাম, কিন্তু সকল রোগেই আমাদের এমন প্রোটকল নির্ভর, নিরাপদ, ভালো ডাক্তার, খারাপ ডাক্তার না খোঁজা, দেশের সকল প্রান্তে একই চিকিৎসা নিশ্চিত করা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দরকার।

আপনাদের কি মনে হয়, এইরকম নিরাপদ একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের হবে?

আশাবাদী হতে দোষ কোথায়!

হৃদিতা রোশনী:
Related Post