X
    Categories: ভাবনা

আমি হয়ত ডাঃ শামারুখের মত নিউজ হয়ে যেতাম

লেখকঃ ডাঃ নাসিমুন নাহার

গত কিছুদিন ধরে এই ভাবনাটা আমাকে পেয়ে বসেছে। প্রথম প্রফের পরে আমার বিয়ে হয়ে যায়, পাত্র ইঞ্জিনিয়ার, বড় কোম্পানিতে চাকরি করে, গাড়ি, বাড়ি সব আছে! সত্যি সত্যি ইঞ্জিনিয়ার, মিথ্যা না কিন্তু, পুরো ফ্যামিলি এডুকেটেড, মা বাবা ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা, বোনরা ডাক্তার। আমি আমার আব্বু আম্মুর প্রিন্সেস ছিলাম। নানুবাড়ি দাদুবাড়িতে সবার চোখের মনি ছিলা্‌ম ফ্যামিলির বড় মেয়ে হওয়াতে সবার রাজকন্যা হিসেবেই বড় হয়েছি । গান জানতান, ডিবেট করতাম, স্টুডেন্টও ভালো ছিলাম। কিছু লেখালেখিও করতাম, যেটা পারতাম না সেটা হল রান্না। আর এটাই আমার প্রথম দোষ হয়ে দাঁড়াল। বড়লোকের আহ্লাদি মেয়ে কিছুই নাকি শিখায় নাই আমাকে- শুধু চোখের পানিই ফেলতে জানি।

রান্না শিখলাম, এরপর আমার দোষ বের হল মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ে, কবে নাতি হবে? নাতির মুখ না দেখে মরলে নাকি শান্তি হবে না!! সৌভাগ্যক্রমে কনসিভ ও করলাম, কিন্তু তাতেও সমস্যা, নাতিই চাই, আমার কোন ভাই নাই, তাই নাকি খুব রিস্ক(!) আছে আমার মেয়ে হবার। আমাকে সেটা বলাও হল যেভাবে পারো নাতিই (নাতনী নয়) জন্ম দিবা। সামনে প্রফ ছিল আমার, প্রফের পড়া পড়ব নাকি নিজের প্রেগনেন্সি কমপ্লিকেশন নিয়ে ভাবব নাকি নাতি/নাতনী নিয়ে ভাববো । একের পর এক আইটেম ক্লিয়ার করে প্রফ ক্লিয়ারেন্সের জন্য দৌড়াচ্ছি সেই সাথে টাইমলি খাবার খাচ্ছি যেন বাচ্চা লো বার্থ ওয়েট না হয়, আমাকে সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে হবে আমার প্রফ ও পাশ করতে হবে। ছেলে বাচ্চাই হল আমার। সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় আমার সাথে ছিলেন হয়ত, আর ছিলেন আব্বু, আম্মু বোনেরা। প্রেগনেন্ট কন্ডিশনেও আমাকে ফিজিক্যাল টর্চার সহ্য করতে হয়েছে, এমনকি আমাকে এটাও বলা হয়েছে প্রেগনেন্ট হয়েছ বলে আলাদা কোন এটেনশন যেন আশা না করি, সব মেয়েই প্রেগনেন্ট হয় এটা স্পেশাল কিছু না। আমি চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিলাম, কারণ আমি জানতামই না কিভাবে এসবের বিরুদ্ধে কিছু বলব, আমার যুক্তিবাদী মনটা অনেক আগেই মরে গিয়েছিল, আব্বু আম্মুকেও কিছু জানাতে পারছিলাম না, তারা কষ্ট পাবে বলে। কিন্তু সত্য সত্যই, চাপা থাকে না বিশেষ করে মায়ের কাছে, মায়ের চোখে সবই ধরা পড়ে। আমার আম্মুও বুঝতে পারলে কোন সমস্যা হচ্ছে।

ছেলে বাচ্চা জন্ম দিয়েও আমার দোষ কাটলো না, মা হয়ে গেছি, প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ে আর পাশ করা হবে না, ডাক্তার বউ আর দেখা হল না । ততদিনে আমি আর আগের আমি নাই, পাথর হয়ে গেছি। নিজের কাছে নিজের প্রমিস করলাম আমাকে যেকোন ভাবেই হোক ডাক্তার হতেই হবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে হলাম, ইন্টার্ন পিরিওডে সিদ্ধান্ত নিলাম এর শেষ আমি দেখব, পরে পরে আর মার খাব না। আমার বাসা থেকে ওদের হ্যাপি করার জন্য ফ্ল্যাট ডেকোরেট করে দেয়া হল যাতে অন্তত আমার বাচ্চার জন্য হলেও ওরা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু লোভ এত খারাপ জিনিস এটা কমেই না, বারে। ফাইনালি আমার বাচ্চাকেও ওদের নেগেটিভ সাইড দেখতে হল। নিজে যেটা মেনে নিচ্ছিলাম বাচ্চার জন্য সেটা মানতে পারছিলাম না, ততদিনে আমি বুঝে গেছি একটা ফ্যামিলিতে আমি ভ্যালুলেস হলেও বাকি পৃথিবীতে আমি ভ্যালুলেস না। আমাকেও ভালোবাসার জন্য অনেক মানুষ আছে। আমার আব্বু আম্মু, বোনেরা, আমার বাচ্চাটা, আমার বন্ধু, আত্নীয়, রোগীরা। তাই আমাকে অন্তত বেঁচে থাকতে হবে। আমিও শামারুখের মত একদিন আমার আব্বুকে ফোন দিয়েছিলাম, বলেছিলাম আব্বু আমাকে নিয়ে যাও, আমি আর পারছি না। আমি ভাগ্যবান যে আমার আব্বু ২ ঘন্টার মধ্যে আমার কাছে চলে এসেছিল। আমাকে আর আমার বেবিকে নিয়ে এসেছিল। এখন আমি নিজের আর আমার বেবির রেসপন্সিবিলিটি নিয়ে নিজেকে এই পৃথিবীর জন্য যোগ্য প্রমাণ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি……… আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাবো না এই প্রমিস নিয়ে। তারপরেও মাঝে মাঝে যখন অতীত সামনে চলে আসে তখন মনে হয় ঐ সময়টা আমার জীবনের একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কারো সাথে এই টপিক শেয়ার করতে চাই নি তবে আজ মনে হল আমার ঘটনা থেকে যদি কারো একটু সাহস বাড়ে , আর এই সব ঘটনার জন্য নিজেকে কখনোই ছোট মনে করা উচিত না, লোকে কি বলবে এটা ভাবার থেকেও অনেক বেশি ইমপর্টেন্ট হল নিজের ভালো ভাবে বেঁচে থাকা।

যে মানুষটা শুধুমাত্র স্পার্ম ডেলিভারি দেয়াকে (আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত এই শব্দ ব্যবহার করার জন্য) বাবা হবার একমাত্র রেসপন্সিবিলিটি মনে করে আমি কেন সারাজীবন তার জন্য চোখের পানি ফেলে যাব, আমি কেন তার জন্য নিজের বাবা মা কে কষ্ট দেব? কেন আমার বেবিকে অসুস্থ পরিবেশে রাখব? এতটা বোকা হওয়া কি একজন ডাক্তার এর মানায়? ৮ বছর ধরে ভায়োলেন্স সহ্য করে এডজাস্ট করতে যেয়ে আমি যে মানসিক ভারসাম্য হারায়নি, পড়াশুনা ছাড়ি নি, মা হিসেবে নিজের রেসপন্সিবিলিটি থেকে সরে আসিনি এর জন্য আমি নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দেই আর সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ থাকি। আর আজ যখন কেউ আমার বেবিকে জিজ্ঞেস করে বাবু তোমার বাবার নাম কি? সে যখন উত্তর করে – ডাঃ মিম্মি, মা না বাবু বাবার নামও বল, তখনও যখন আমার ছেলে একই উত্তর দেয় তখন আমার চোখে পানিতে ভরে ওঠে, আনন্দে। হুম, আমিই আমার বাচ্চার বাবা এবং মা। একজন ডাক্তার যদি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে তাহলে একটা বাচ্চার বাবা মা দুটোই হতে পারবে না কেন? আমার আব্বু আম্মু ও আজ আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে, আমি পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে অনেক সম্মানজনক নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছি দেখে।

ডক্টরস ডেস্ক: bddoctorsplatform@gmail.com

View Comments (37)

  • Hats off...may you become an inspiration to others. Best wishes to you and your child. Take great care of yourself and the child.

  • i had tears after reading your story..don't get me wrong..this tears came from joy...

    Salute to you...wish you the best to you and your prince..

    it's really high time to change our mindset

  • অনেক অনেক অভিনন্দন আপনাকে। ধন্যবাদ আপনার বাবা-মা ও পরিবারের সবাইকে। বাংলাদেশের সব নির্যাতিত মেয়েরা যদি আপনার মতো সাহসী হতো, তা'হলে অনেক জীবন বেঁচে যেতো। যাইহোক আশা করবো আপনার লেখা পড়ে যদি একজন মেয়েও প্রতিবাদী হয়ে বেঁচে যায়, তবেই আপনার লেখাটা সার্থক হবে। সব শেষে আপনার ও আপনার ছেলের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি।

  • Thanks for sharing your inspirational story. I wish you had shared it earlier , then Shamarukh might have got courage from you. Believe in yourself, you can do any thing if you have faith in you. I wish all the good things happen to you and your child.

Related Post