X

আর্তমানবতার সেবায় কাইলাকুড়ি হাসপাতাল, বাংলাদেশি চিকিৎসকদের অবদান

৩ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৮৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা দেবার নিমিত্তে ‘কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট’ চালু করেন ‘ডাক্তার ভাই’ নামে খ্যাত নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী ডা. এড্রিক সার্জিসন বেকার। ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মানবতার এই মহান সেবক পরলোকগমন করেন। তিনি যেই মডেল চালু করে দিয়ে গেছেন মধুপুরে, এটি যেন হারিয়ে না যায়, এটিই ছিল ডাক্তার ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে।

ডা. এড্রিক বেকারের এই শেষ ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে আসেন মার্কিন চিকিৎসক দম্পতি জেসন-মারিন্ডি। তাঁরা ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সপরিবারে চলে আসেন মধুপুরে। গত ২৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে “ইত্যাদি” তে সম্প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় তাঁদের এই আত্নত্যাগের গল্প।

কিন্তু যেই গল্পটি সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, তা হল কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রোজেক্ট (KHCP) এ বাংলাদেশের ডাক্তারদের অনস্বীকার্য ও অবিস্মরণীয় অবদান; যারা সেবা দিয়ে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে, নিজ উদ্দ্যোগে, দেশের গ্রামীন ও অবহেলিত মানুষকে ভালোবেসে। KHCP এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এদেশের চিজিৎসক সমাজ, বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত হাসপাতাল, সেবা দানকারী বিভিন্ন পর্যায়ের মেডিকেল প্রতিষ্ঠান। এরা নিয়মিতভাবে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। নিম্নে কিছু চিত্র তুলে ধরা হলোঃ

১) শ্রদ্ধেয় ডা. ভাই (ডা. এড্রিক বেকার) গত হবার পর থেকে বর্তমান ডা. দম্পতি আসার অর্ন্তবর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা. মো. রাকিবুর ইসলাম কোনো পারিশ্রমিক না নিয়ে নিজ উদ্যোগে কর্মরত থেকেছেন এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসকগণ সবসময় উপস্থিত থাকেন।

২) ‘ডক্টর’স কমিউনিটি ভিজিট’ এর ব্যানারে কিছু সম্ভাবনাময় ও তরুণ চিকিৎসক KHCP এ সংকট ও প্রতিকূল অবস্থার পাশাপাশি অন্য সময়েও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্য করে থাকেন।

৩) সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ বিভিন্ন রকম অপারেশন, প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে থাকে।

৪) বারডেম হাসপাতালের অবদান আলাদাভাবে না বললেই নয়। বারডেমের সমাজ কল্যাণ বিভাগ স্বল্পমূল্যে বা কখনও বিনামূল্যে বিভিন্ন মেয়াদি প্রয়োজনীয় ইনসুলিন ও ওষুধ দিয়ে থাকে। এছাড়াও চোখের ছানি অপারেশন, খারাপ ডায়াবেটিক আলসার (ডায়াবেটিক ফুট), ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসা, লেজার অপারেশন সহ নিয়মিতভাবে ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

৫) ঢাকা ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ বিভিন্ন ধরনের অপারেশন, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, পরীক্ষা নিরীক্ষা সহ অন্যান্য চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে।

৬) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সিজার, DNC ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা দিয়ে থাকে।

৭) ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনের একটি উপশাখা আছে কাইলাকুড়িতে। সেখানে যক্ষ্মা ও যক্ষ্মাজনিত সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

৮) সাভারের সিআরপি নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, হুইলচেয়ার প্রদানসহ ফিজিওথেরাপি সেবা প্রদান করে।

৯) বারডেম হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডা.তাহমিনা বেগম শিশুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণে বিভিন্ন পেডিয়েট্রিক যন্ত্রপাতি, আর্থিক অনুদান প্রদানসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন।

১০) কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি এন্ড অবস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধেয় সহযোগী প্রফেসর ডা. পারভীন রহমান বিভিন্ন গাইনকোলজিকাল সমস্যার চিকিৎসা ও বিভিন্ন অপারেশন স্বল্পমূল্যে করে থাকেন।

১১) শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডা. শরিফ বিনামূল্যে ঠোঁট কাটা, তালু কাটা ও প্লাস্টিক সার্জারি করে থাকেন।

১২) শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডা. সমান্ত লাল সেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক, তিনি পোড়া রোগীদের বিভিন্ন পরামর্শ ও চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন।

১৩) মেডিসিন ক্লাব ও সন্ধানীর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগী অপারেশনসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে রক্তের যোগান দিয়ে থাকে।

১৪) বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে বিনা খরচে চোখের পরীক্ষা, ছানি অপারেশন, চশমা ও ওষুধ দেওয়া হয়।

এছাড়াও চিকিৎসক সমাজ, মেডিকেল স্টুডেন্ট ভিজিটের মাধ্যমে খোঁজখবর ও বিভিন্ন সময়ে তাদের সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন।

উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানে কাইলাকুড়ি থেকে রেফারেল রোগী পাঠানো হয়। উল্লেখ্য যে, প্রয়াত ডা. এড্রিক বেকার বেঁচে থাকাকালীন এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, একটা প্রতিবেদনের মাধ্যমে ডাক্তার সমাজের এই সব অবদান ম্লান হয়ে যায় না। বাংলাদেশী ডাক্তারদের কথাটা যে কারণেই হোক প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। তাই বলে আমরা যেমন এদেশের ডাক্তারদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে অশালীন মন্তব্য করতে পারি না, তেমনি আমেরিকান ডাক্তার দম্পতির অবদানকেও ছোট করে দেখতে পারি না বা প্রয়াত ডাক্তার ভাই এর নামে কোন প্রকার অপপ্রচার ও করতে পারি না।

সুখী, সমৃদ্ধ, সম্ভাবনাময় ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ সাধ্যের অধিক সংখ্যক জনগণকে বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিরলস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নীরবে – নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। আর্তমানবাতার সেবায় তাঁদের এই অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং গৌরবের।

তথ্যসূত্র : ডা. মো. রাকিবুর ইসলাম
স্টাফ রিপোর্টার/ ফাহমিদা হক মিতি

Platform:

View Comments (1)

Related Post