X

“আমি স্থির হাতে ল্যারিঙ্গোস্কোপ নিই, আমার চোখভরা পানি”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ অক্টোবর, সোমবার, ২০২১

লেখাঃ ডা. শাহাজাদ হোসাইন মাসুম
সহকারী অধ্যাপক, এনেস্থেসিওলজি
৫০০ শয্যা বিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল

কোথাও কিছু পড়তে গিয়ে চোখে পড়েছিল একজন চিকিৎসকের স্বজন হারানোর সময়ের কথা। তিনি তখন কাজে ছিলেন। ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেননি। এই ব্যাথা তিনি সারাজীবন বয়ে চলেছেন। অসংখ্য মানুষের এমন গল্প আছে। তবে একজন চিকিৎসকের এই ব্যাথার ভারটা দুঃসহ। যার মনে হবে, কেন? তিনি এইটুকু পড়ে আর পড়বেননা। এই কেনর উত্তরটা আপনি বুঝবেননা।

অনেকের মতো আমার জীবনেও এমন একটি ঘটনা আছে। আমার মায়ের মৃত্যুর তিন দিন আগের কথা। তাঁকে আমি ঢাকায় আমার বোনের বাসায় রেখে বাড়ি ফিরেছি আরো কয়েকদিন আগে। বড় ভাই ডাক্তার দেখানো এবং অন্যান্য কাজগুলো করছিলেন।

মৌলভীবাজারে আমি খুব বেছে বেছে অল্প কয়েকজন সার্জনের সাথে কাজ করতাম। তার মাঝে সাদী ভাই একজন। সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজে ই এন টির সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন তখন। মৌলভীবাজারের অভিজাত পরিবারের ছেলে। চমৎকার সিলভার গ্রে চুল ছিল তাঁর। কাজে খুবই দক্ষ এবং সজ্জন মানুষ ছিলেন।

সেইদিন তাঁর তিনটা অপারেশন ছিল। প্রথম রোগী টনসিলেক্টমী, একজন কিশোর রোগী। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ করে, রোগীকে অভয় দিয়ে কাজ শুরু করি। ঠিক তখনই প্রথমবার মোবাইলে কল আসে। মোবাইল একটু দূরে রাখা, বিরক্ত হয়েই কাজ করতে থাকি, ড্রাগস দেওয়া শেষ, আমি ব্যাগ মাস্ক ভেন্টিলেশান করছি, রোগী প্যারালাইজড হচ্ছে, ফোন বেজেই চলেছে। ওয়ার্ডবয় ফোনটা নিয়ে এসে ইতস্তত করে বলে, স্যার আপনার বড়বোন। আমি স্ক্রীনে লেখা দেখি ‘বড় আপা’। শঙ্কিত মনে ফোনটা ধরতেই শুনি ওপাশে সবার চিৎকার আর কান্না, আমার হাত চলছে, কাজ করছি আর শুনছি, বড় আপা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ভাইয়া আম্মা শ্বাস নিচ্ছেন না, নীল হয়ে গেছেন। আমি কোন রকমে বলি, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যা, তারপর কল কাটি। তারা তখন দুইটা গাড়ি, ড্রাইভার বাসায় রেখে পাগলের মতো এ্যাম্বুলেন্স খুঁজছে। এটা সেই প্রথম কিছু মিনিট যখন বিপদে মানুষ অবশ হয়ে যায়। আমি স্থির হাতে ল্যারিঙ্গোস্কোপ নিই, আমার চোখভরা পানি, সেই পানি মুছে ফেলে আমি পেশেন্টকে ইন্টিউবেইট করে মেশিনে এটাচ করি। সাদী ভাই জিজ্ঞেস করেন, খারাপ কিছু? আমি চোখের পানি আটকাতে পারিনা। উনি বললেন, শাহজাদ, আপনি পেশেন্ট রিভার্স করে দেন, আমি রোগীর লোকজনকে বুঝিয়ে বলি, আপনি রওয়ানা দেন। আমি নিষেধ করি। কাজটা নৈতিকতার দিক দিয়ে শুদ্ধ নয়। তাঁকে কাজ শুরু করতে বলি। আবার বড়আপাকে ফোন করি, তারা ততক্ষনে সি এম এইচে পৌঁছেছে। আমি চেষ্টা করতে থাকি একজন বিকল্প এনেসথেশিওলজিষ্টকে পেতে। কিন্তু মফস্বল শহরে তখন অল্প কয়জন এনেসথেশিওলজিষ্ট, সবাই ব্যস্ত। আমি চোখ মুছতে মুছতে কাজ করে যাচ্ছি। মাঝামাঝি সময়ে একজন সহকর্মী এসে আমাকে রিলিফ করেন। ততক্ষনে জেনেছি আম্মাকে সি পি আর দিয়ে ফেরানো হয়েছে এবং ভেন্টিলেটরে দিয়ে আই সি ইউতে রাখা হয়েছে।

বাসায় ফিরে আমি আব্বার পাশে বসে ধীরে ধীরে খবরটা বলি এবং দুইজন দুইজনকে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। আসেন অনেক সহকর্মী। সেই রাতে আমাকে আর আব্বাকে ঢাকায় পৌঁছে দেয় Shahin। তখন রাত প্রায় চারটা।

আমার সাথে আম্মার দেখা হয়েছিল। তিনি কয়েক ঘন্টার জন্য ফিরেছিলেন। আমাদের সাথে কথাও বলেছিলেন। তারপর তিনি মারা যান। সেই গল্পটি আমি সম্পূর্ন না হলেও আংশিক বলেছি। সম্পূর্ন গল্পটিতে তরুণ চিকিৎসকদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। জীবনে জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নেই, কিন্তু এই জ্ঞান যেন তোমাকে কখনোই এতটা আত্মবিশ্বাসী না করে ফেলে যে তুমি এই বিষয়ে সব জানো। আর কারো কোনো কথা তোমার শোনার প্রয়োজন নেই। তুমি তখন ইগোর কাছে বন্দী হয়ে যাবে। এই ইগোর কারণে যদি একজন রোগীও তোমার হাতে মারা যান তাহলে তাঁর স্বজন সারাজীবন তোমার নামটা মনে রাখবেন।

যেমন আমি রাখি।

হৃদিতা রোশনী:

View Comments (2)

Related Post