X

হৃদরোগ প্রতিরোধ ও তার নিরাময় নিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য

আরমান আহমেদ (ছদ্মনাম)। পেশায় ডেন্টাল সার্জন। নিজে চিকিৎসক ছিলেন বলে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বরাবরই। প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটতেন, খাবারেও অতিরিক্ত তেল-চর্বি এড়িয়ে চলতেন সবসময়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল কিছুই তার ছিলো না। ওজনও ছিলো শতভাগ নিয়ন্ত্রণে। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, তার হার্ট অ্যাটাক করেছে। তিনি সিসিউতে ভর্তি আছেন।

আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব কারোরই বিশ্বাস হতে চাইলো না খবরটা। এমন পরিমিত আর নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন যার, তার কীভাবে হার্ট অ্যাটাক হলো। দিন কয়েক বাদে ধীরে ধীরে একটু সুস্থ হতে শুরু করলে ডাক্তার তার কেস-হিস্ট্রি নিতে গিয়ে বুঝলেন, আরমান সাহেবের হার্ট অ্যাটাকের কারণ মূলত তার মানসিক চাপ। পারিবারিক কিছু অশান্তিতে ভুগছিলেন, মাস কয়েক ধরে একটা অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, অসহ্য এক স্ট্রেস প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো তাকে। যার অন্যতম পরিণতি এই আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক।

ধূমপান, মেদস্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার ইত্যাদির পাশাপাশি টেনশন ও স্ট্রেস হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। গত শতকের শেষভাগে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ, বিশেষত হৃদরোগের সাথে স্ট্রেসের যোগসূত্রের বিষয়টি তো এখন স্পষ্ট।

মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন বলেন, হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ মানসিক চাপ। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি দেখিয়েছেন যে, কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিতে রক্ত চলাচল কমিয়ে দিলেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। দেখা গেছে, করোনারি আর্টারির ৮৫শতাংশ বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌঁড়ে অংশ নিয়েছে; আবার শুধু স্ট্রেস, টেনশন বা মানসিক চাপের কারণে একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়ে আরেকজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান তার সহকর্মী রোজেনম্যানকে নিয়ে পঞ্চাশের দশকে একটি গবেষণা- প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাতে বলা হয়, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, তীব্র অনুভূতিপ্রবণতা- অর্থাৎ নেতিবাচক জীবনদৃষ্টির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আর এ ধরনের ব্যক্তিত্ব-বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যাদের মধ্যে তাদেরকে গবেষকদ্বয় অভিহিত করেন টাইপ এ ব্যক্তিত্ব (Type A Personality ) হিসেবে। ১৯৭৪ সালে তারা এ নিয়ে একটি বইও লেখেন-‘টাইপ এ বিহেভিয়ার অ্যান্ড ইয়োর হার্ট’। বইটি তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। মূলত তখন থেকেই টাইপ এ পার্সোনালিটি বাক্যটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলধারায় ব্যাপক পরিচিতি পায়।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্যে চাই মানসিক প্রশান্তি ও সঠিক জীবনদৃষ্টি। আর মানসিক প্রশান্তি ও চাপমুক্ত জীবনের জন্যে মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ -এর মহাসচিব জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক তার আত্মজীবনী ‘জীবনের কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শরীরের ওপর মনের প্রভাব অপরিসীম। তাই দেহের পাশাপাশি মনের যত্ন নেয়াও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন বা আত্মা ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকে না। কাজেই আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে নিয়মিত নামাজ, প্রার্থনা ও মেডিটেশন করা উচিত। চাপমুক্ত জীবনযাপন, মানসিক সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্যে রিলাক্সেশন বা শিথিলায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে তাই এটি দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে’।

একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি এখন প্রমাণিত সত্য যে, মেডিটেশন হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় দু’ক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখে। সাধারণভাবে, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। মেডিটেশন এই অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে।

মেডিকেল কলেজ অব জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট ডা. বার্নেস ১১১ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর একটি গবেষণা চালান। তিনি বলেন, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে আগে যে ফল পাওয়া যেত, তা-ই পাওয়া সম্ভব মেডিটেশনে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে তিনি এ রিপোর্টটি পেশ করেন।

এছাড়াও ১৯৭৯ সালে দু’জন গবেষক এম জে কুপার এবং এম এম আইজেন ২৩ জন উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর মধ্যে ১২ জনকে মেডিটেশন করান। ১১ মাস পর দেখা যায় যে, মেডিটেশনকারী দলের কোলেস্টেরল ২৫৫ থেকে ২২৫-এ নেমে এসেছে।

মেডিটেশন করোনারি ধমনীর ব্লকেজ ও রক্তচাপ কমায়- বিজ্ঞানীরা এতদিন জানতেন শুধু এটুকুই। কিন্তু মেডিটেশনের মনোদৈহিক প্রভাব সম্বন্ধে সাম্প্রতিক যে তথ্যটি এখন তাদের আলোচনার বিষয় তা হলো, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধসহ হৃদরোগজনিত যেকোনো অকালমৃত্যু ঠেকাতে মেডিটেশন অত্যন্ত কার্যকরী।

আমেরিকায় ২০১ জন আফ্রো-আমেরিকান হৃদরোগীকে নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় শতকরা ৪৭ ভাগ কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে গবেষকদের একজন থিওডর কচেন্ বলেন, মানুষ ওষুধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু আমাদের গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হলো যে, স্ট্রেসজনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী পন্থা মেডিটেশন। রিডার্স ডাইজেস্ট-এ প্রকাশিত হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা বিষয়ক একটি স্বাস্থ্য-প্রতিবেদনে এ তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়। শুধু তা-ই নয়, হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে মেডিটেশনের ভূমিকার সত্যতা এখন স্থান পেয়েছে কার্ডিওলজির প্রধান প্রধান পাঠ্যবইয়ের সাম্প্রতিক সংস্করণগুলোতেও।

Hurst’s : The Heart বইটির দ্বাদশ সংস্করণে বলা হয়েছে- ‘… মেডিটেশন জীবনে শৃঙ্খলা নিয়ে আসে। শরীর স্থির হয়, মন হয়ে ওঠে প্রশান্ত। এর ফলে একটি নিরাময়ের অনুরণন সৃষ্টি হয়, যা হৃদরোগের ভীতিকর বুকব্যথা থেকে মুক্তি দেয় এবং জীবনমানের উন্নতি ঘটায়। হৃদরোগীদের জীবনধারা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাই এর ভূমিকা রয়েছে এবং এটি এথেরোরিগ্রেশন করে বা করোনারি ধমনীতে জমে থাকা কোলেস্টেরলের নিঃসরণ ঘটায়।’ (পৃষ্ঠা ২৪৬৮)।

Braunwald’s Heart Disease বইটির অষ্টম সংস্করণে ১১৫৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে- ‘… মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম, গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস (প্রাণায়াম) ব্যথা-বেদনা ও দুশ্চিন্তা দূর করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পদ্ধতিতে মানসিক চাপ কমে ও রোগ নিরাময় সুসম্পন্ন হয়। এছাড়াও মেডিটেশন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।’

তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্যে মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করুন। আর তা সম্ভব নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যানমগ্নতায়। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট মেডিটেশন আপনাকে নিয়ে যাবে নতুন আনন্দলোকে। প্রশান্তি হবে আপনার নিত্যসঙ্গী। অযাচিত সব দুঃখ-কষ্ট আর নেতিবাচকতা আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে দূরে, অনেক দূরে। আপনি হয়ে উঠবেন সুস্থ সুন্দর প্রাণবন্ত এক নতুন মানুষ।

 

সূত্রঃ অনলাইন

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation
Related Post