X

সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তারদের মানসিক স্বাস্থ্যের খবর রাখছি কি?

শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১

রমজান মাসের প্রায় মাঝামাঝি সময় এখন। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। রোজায় না খেয়ে থাকতে হয় প্রায় ১৪ ঘন্টা। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওয়ার্ডে বা ডিউটিরুমে কোন এসি নাই। এদিকে ওয়ার্ডে রোগীর কোন কমতি নাই, সিট খালি নাই কোথাও। তাই রোগী রাখতে হয় ফ্লোরেও। রাতদিন ২৪ ঘন্টা সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল সদা জাগ্রত। গাইনী ওয়ার্ডে কখনো কেউ ঢুকলে বুঝবেননা এখন রাত না দিন। কারণ দিন-রাত ২৪ ঘন্টায় ৩৬ ঘন্টার সমান প্রসব ও প্রসব জনিত জটিলতা সামলাতে হয় এখানে। বাচ্চা হওয়াতো বন্ধ হবেনা কখনো, সাথে প্রসব জনিত জটিলতা তো আছেই। একই চিত্র সব ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের- সে কোভিড-ননকোভিড যাই হোক না কেন।

রাতদিন এইসব ওয়ার্ড-ইমার্জেন্সি সামাল দিচ্ছে কোন ডাক্তাররা? আমাদের ট্রেইনিরা,মেডিক্যাল অফিসার, পোস্ট গ্রেজুয়েট ছাত্র, অনারারি, ইন্টার্নরা।আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম-সম্মুখযোদ্ধারা।বড়রা অনেকেই মাঝে মাঝে আক্ষেপ করলেও আমি খুব আশাবাদী সবসময় তাদের নিয়ে। করোনা কালে তাদের ভূমিকায় বুক ফুলিয়ে আমরা গর্ব করে বলতে পারি এই বলে, সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়ে এই কঠিন সময়ে সম্মুখে থেকে যুদ্ধটা তারাই সামলিয়েছে এবং সামলে যাচ্ছে। স্যালুট তাদের।

আজ কেন এত ভূমিকা করছি? কারণ আছে!
আজ আমাদের এক সিনিয়র গাইনী শিক্ষক মনে প্রশ্ন জাগিয়েছেন (যিনি গোপনে তাঁর মত করে সম্মুখযোদ্ধাদের জন্য করে যাচ্ছেন) তারা কিভাবে ডিউটিরত অবস্থায় সেহেরী খাচ্ছে, কীভাবে ইফতার করছে ,তাদের যত্ন নেয়ায় বড়রা কি করছে? আমাদের কিছু কি করার আছে? তাদের সাথে সম্মুখভাগে কাজ না করলেও- তাদেরকে মানসিক সাহস যোগাতে, তাদের খোঁজ-খবর রাখায় আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই?

আছে, অবশ্যই আছে। কেননা করোনার ১৪ মাস পর চিকিৎসা একটা নিয়মের মধ্যে আসলেও যারা টানা ডিউটি করছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ম মাফিক চলছে না। এমতাবস্থায় নিজেদের, সিনিয়রদের, সরকার, সমাজের অনেক দায়িত্ব আছে।

আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন সদ্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন-

করোনা মহামারী সবাইকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ও বিচলিত করেছে- বিশেষ করে সামাজিক ভাবে আইসোলেশনের কারনে। এর মাঝে ডাক্তাররা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। কারণ, তাদের আছে নিজের ভয়, নিজের পরিবার আক্রান্ত হবার ভয়, একসাথে অনেক রোগীর চিকিৎসার চাপ ইত্যাদি। সবকিছুর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে চিকিৎসকদের মানসিক অবস্থা তথৈবচ! তাই রোগী সামলানোর সাথে সাথে নিজেকেও সামাল দিতে হবে সচেতন ভাবে।

কিন্তু কিভাবে? নিজের যত্ন নিতে হবে।

বিমান উড্ডয়নে ঝুঁকির সময় কেবিন ক্রু যেমন আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক পরে তারপর অন্যদের পরায়। ঠিক তেমনই ডাক্তারদের নিজেদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন আগে নিতে হবে। যে পদক্ষেপ গুলো নেয়া যায়-

১) নিজের মনের অনুভূতি অনুভব করুন বিন্দাস ভাবে (Feel free to feel your feelings)

ডিউটিরত আপনি, আপনার সাথে আপনার কলিগ সবাই এ মহামারীতে ভয় পেতেই পারেন। আক্রান্ত হবার ভয়, অতি রোগীর চাপ সামাল দেয়ার ভয়, হাতের কাছে সব যন্ত্রপাতি সময়মত না পাওয়ার টেনশন, এই গরমে জবরজং পিপিই পরে থাকার ধকল, চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাওয়ার স্ট্রেস ইত্যাদি সব চাপে আপনি চ্যাপ্টা হতেই পারেন। এ চাপটা অস্বাভাবিক না। এ চাপ অনুভব করুন। কারণ আপনিও তো মানুষ! এ অনুভূতি অনুভব করা আপনার দুর্বলতা কিংবা অযোগ্যতা না।

২) সচেতনভাবে নিজেকে সামলে নেয়ার কৌশল নির্ণয় করা

অতীতে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে নিজেকে কিভাবে সামলাতেন সেটাই নিয়ম করে এখন করুন। সেটা হতে পারে অবসরে কুম্ভকর্ণের ঘুম কিংবা দুই শিফটের মধ্যে ক্ষণিক সময় বের করে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়া, সময়ের খাবার সময়ে খাওয়া (অবশ্যই স্বাস্থ্য সম্মত), শারীরিক ভাবে কর্মঠ থাকা, যেমন- ব্যায়াম, বাগান করা, পরিবার-আত্নীয় স্বজন-বন্ধুর সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি।

৩) নিয়মিত নিজের মানসিক অবস্থা যাচাই করুন

সেটা কিভাবে? আপনাদের মনে আছে সেই এড এর কথা? “বিষন্নতা একটা রোগ।”
নিজের মাঝে বিষণ্নতার লক্ষন আছে কিনা দেখে নিন নিয়মিত। যেমন- দীর্ঘক্ষণ মন খারাপ, ঘুম আসতে সমস্যা, নিজেকে অসহায় মনে হওয়া, খারাপ কোন কিছু মাথা থেকে দূর করে দিতে না পারা।এসব হলে আপনার কাছের কলিগ বা সিনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। যদি লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন থাকে প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

৪) খবর ও মিডিয়া থেকে ব্রেক নিন

নিয়ম করে কিছু সময় গ্যাজেট থেকে দূরে থাকার অভ্যাস করুন।যখন সোশ্যাল মিডিয়ার খবর দেখবেন, দেখে নিন খবরের সোর্স বিশ্বাসযোগ্য কিনা।মনে করবেন না ২৪/৭ যা পৃথিবীতে ঘটছে তা সবই আপনার জানতেই হবে।

৫) নিজের পেশার ও কাজের গুরুত্বকে সামনে রেখে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন

নিজেকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিন, আপনি সৃষ্টিকর্তার অতি প্রিয়।তাই তিনি আপনাকে এ পেশায় আসার সুযোগ করে দিয়েছেন।যাতে মানুষের সবচেয়ে খারাপ সময়ে সহযোগিতা করার সুযোগ পান। আপনার যে কলিগরা আক্রান্ত হয়েছে, শহীদ হয়েছে তাদের আত্মত্যাগ এর কথা স্মরণ করে নিজের প্রতি যত্নশীল হোন আর দ্ব্যর্থ ভাবে মানুষের সেবায়নিজেকে নিয়োজিত করুন। মনে রাখতে হবে-একা আমরা কিছুই না, কিন্তু সবাই মিলে আমরা বিরাট শক্তি।

৬) আপনার অধীনস্থদের যত্ন নিন

সবার কাজের শিফট, সময়, ধরণ ও পদ্ধতি ঠিক করে দিন। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের খবর নিন। প্রয়োজনে সঠিক সহায়তা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। কেউ আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সাপোর্ট দিন। সবাই যাতে কাজের সময় সমস্যা বা সবকিছু নিয়ে মনখুলে কথা বলতে পারে সে পরিবেশ তৈরী করুন।

৭) রোগীদের যত্ন নিন, নিজের মন ভাল হয়ে যাবে

-রোগীদের শারীরিক চিকিৎসার সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা সেটার দিকেও খেয়াল রাখুন।
-স্টাফ ও রোগীদের সাথে মানবিক ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিন।
-রোগীর রেফারেল পদ্ধতির উপর গুরুত্ব দিন।ইয়েলো-রেড- HDU- ICU কখন কোন রোগী কোন স্তরে যাবে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিন।
-রোগীদের কাছে তাদের শারীরিক অবস্থার কথা শেয়ার করুন। সমস্যা কম হবে।
-রোগীর চিকিৎসায় সাইকিয়াট্রি বিভাগকে সমন্বয় করা যায় কিনা সে ব্যাপারে সিনিয়রদের চিন্তার অবকাশ আছে।

৮) সিনিয়রা যেভাবে পাশে থাকতে পারেন

-সঠিক সময়োপযোগী তথ্য দিয়ে রোগীর চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা.. সাথে নিজেকে নিরাপদ রেখে কাজ করার যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সিনিয়র নিতে পারেন। সম্মুখে যারা আছে তাদের মনে এ আস্থাটা তৈরী করানো যাতে যেকোনো সমস্যাই সামনে আসুক না কেন বড়রা বটবৃক্ষের মত তাদের পাশে থাকবে। সম্মুখযোদ্ধারা যেন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ মনে করে সবসময় সে অনুভব তাদের মনে বড়রাই আনাতে পারেন।
– তাদের খাপ খাইয়ে নেয়ার কৌশল গুলো পালন করার জন্য উৎসাহ দেয়া যায়।”১২ ঘন্টা না ২৪ ঘন্টা করে ডিউটি কর!”– তা না বলে চাপ কিভাবে কমানো যায় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
-তারা যেন সঠিক ব্যবস্থাপনা দিতে পারে সেজন্য সঠিক উপাত্ত সরবরাহ করা যায়।
– সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ করাটা যাতে সহজ হয়- সেদিকেও নজর দেয়া উচিত। সঠিক সময়ে ফোন করে পাওয়া না গেলে বড় অসহায় তারা তখন।
-তাদের আশাবাদী করা যায় এই বলে..’এ কঠিন সময় কাটবেই একদিন..সেদিন দূরে নয়। তোমাদের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ ভাবনা.. সব বাস্তবতার মুখ দেখবে একদিন.. আমরা তোমাদের পাশে আছি সবর্দা তোমাদের সাহস হয়ে।’
– তাদের কাজকে মুল্যায়ন করা।তাদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরন করা – যদি প্রয়োজন হয়।
– টিমে সব কাজের সিদ্ধান্তে তাদের পরামর্শেরও যথাযথ মূল্যায়ন করা।
-তাদের মনোবল সমুন্নত রাখার কর্মপন্থা বাছাই করা।
– কোয়ারান্টাইন কালে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা।
– নিজস্ব অভিমত- এ রমজানে যার যার প্রতিষ্ঠানের সিনিয়ররা ডিউটিকালীন সময়ে সেহেরি -ইফতারের দায়িত্ব নিয়ে তাদের কাজকে সম্মান জানানো, তাদের এটুকু বুঝানো –

“We are always with you.We are proud of you.We acknowledge your immense contribution.”

হতাশার মাঝে রবি বাবুর আশা জাগানিয়া সেই কবিতা না শুনালেই নয়,

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,

বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥

তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,

কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।

নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।”

ডা. ফাহমিদা রশীদ স্বাতি
সহকারী অধ্যাপক, গাইনি & অবস
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

অংকন বনিক:
Related Post