X

শেষ মেইল | ছোট গল্প

“শেষ মেইল”

ডাঃ জহির সাদিক
খুলনা মেডিকেল কলেজ

রাশেদের আজ কোন আউটডোর নেই। তেমন কোন ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। নিজের রুমে বসে আছে। ব্যস্ততার ভিড়ে অনেকদিন মেইলগুলো ঠিকমত চেক করা হয়না। সাইড টেবিলে একটা ডেস্কটপ রাখা আছে। মেইল ওপেন করতে যেয়ে তামান্না নামটি দেখে কিছু সময় স্থির হয়ে রইল। মাসখানেক আগের মেইল হবে হয়তো। রাশেদ গভীর মনোযোগ দিয়ে মেইলটি পড়া শুরু করল।

“শোন, আবার সরি বলছি। এবার গুনে গুনে এক হাজারটা সরি। প্রতিবার প্রমিজ করি যে তোমাকে আর লিখব না। বেশ কিছুদিন জোর করে প্রমিজ ধরেও রাখি। তারপর আর পারিনা। কিছু একটা না লিখলে ভেতরে কেমন জানি অস্থিরতা শুরু হয়।

আচ্ছা তোমারও কি এমন হয়? সম্ভবত না। তাছাড়া হবেই বা কেন? দুজনের অনুভূতি আবেগ এসবতো আর কখনো এক হতে পারে না। এক হলে ভালো হত। তাহলে কষ্ট আর ভালোবাসার পাবার ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে এক ধরনের ভারসাম্যতা তৈরি হত।

একজন অন্যজনের জন্য সারাটা জীবন কষ্ট পাবে। আর সেই অন্যজন অনুভূতিহীন ভাবে পৃথিবীতে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে। এটা কিন্ত খুব বড় ধরনের বৈষম্য।

এবার তোমার জন্মদিনে উইশ করা হয়নি। ইচ্ছে করে উইশ করিনি। ওইদিন খেয়াল করেছি সবাই তোমাকে হ্যাপি বার্থ ডে জানাচ্ছে। সুন্দর সুন্দর কথা লিখছে। ফেসবুক খুললেই তোমার অসংখ্য ভক্তদের কমেন্ট চোখে পড়ে।

আচ্ছা নাবিলা মেয়েটা কে? দেখেতো মনে হয় তোমার মেয়ের বয়সী। এত পাকা পাকা কমেন্ট করে কেন? তুমিতো দেখছি দিনদিন হুমায়ূন আহমেদ হয়ে যাচ্ছ। উনার শেষ পরিণতি কি দেখেছো তো। খুব বেশি সুবিধার না। একটু সাবধানে থেকো।
আমার কথা তুমি আবার সিরিয়াসলি নিও না। এমনিই দুষ্টামি করলাম।

তোমার মেয়েটা না ভীষণ কিউট হয়েছে। গাল টিপে দিতে ইচ্ছে হয়। আমার হয়ে তোমার মেয়েটার গাল টিপে দিও। ও কিন্তু একদম তোমার মত হয়েছে। বিশেষ করে নাকটা।
আমার ছেলে প্রান্ত দেখতে হয়েছে ওর বাবার মত। আর স্বভাব চরিত্র আমার মত। তবে একটা বিষয়ে ভীষন মিল। আমার মত তাড়াতাড়ি কথা বলে।

যাহোক এত লেখার ভীড়ে আমার উইশ করাটা গুরুত্ববহ কিছু ছিল না। তাই দেরিতে হলেও আজ তোমাকে উইশ করছি। জানি আজ কেউ তোমাকে উইশ করবে না। কেউ না। কেবল আমি ছাড়া।

এবার না এখানে খুব ঠান্ডা পড়েছে। নভেম্বর থেকেই বরফ পড়া শুরু হয়েছে। সাধারনত এতটা বরফ কখনো পড়ে না। ঠাণ্ডায় হাতপা জমে যাবার মত অবস্থা।

তোমাকে আমার একটা সুসংবাদ দিই। মাস খানেক আগে এখানকার টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে আমি পাবলিক হেলথে একটা স্কলারশিপ পেয়েছি। কিভাবে যে পেলাম বুঝতেই পারলাম না। অতটা মেধাবী কিন্তু আমি নই। আমার যে মেধা কম এটা তুমি ভালো করেই জানো। কার্ডিওলজীতে একসাথে ট্রেনিং করার সময় আমার পারফর্মেন্স নিশ্চয় তোমার খেয়াল আছে।

এই বয়সে নতুন করে পড়াশুনা করতে আর ভাল লাগে না। এখানে অবশ্য সার্টিফিকেটের বয়স নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু বয়স তো একটা ফ্যাক্টর। তাই না? জানিনা শেষ করতে পারবো কিনা। তারপরও নিজেকে নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকা। বাসায় বসে থাকলে তো হাবিজাবি সব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। পুরনো সব কথা মনে পড়ে।

তুমিতো এখন বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট। অথচ আমাকে দ্যাখো ট্রেনিং শেষ করেই বিয়ে। এত ভাল স্টাবলিসড পাত্র পেয়ে বাবার মাথা ঠিক ছিল না৷ হুড়মুড় করে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারপর জামাই এর হাত ধরে বিদেশ পাড়ি। ফলস্বরূপ সংসার আর বাচ্চা পালন। সেই কবে থেকে নিজস্ব পরিচয়টা হারিয়ে ফেলেছি। আমি যে একজন ডাক্তার এবং মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করেছি এসব এখন ভুলেই গেছি।

মেডিকেল ফিফথ ইয়ারে পড়ার সময় মা যখন হার্ট ফেইলিউরে মারা যান তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কার্ডিওলজীতে ক্যারিয়ার করব। আমারও তোমার মত হার্টের ডাক্তার হবার খুব শখ ছিল। মা এবং হার্ট আমার কাছে সবচাইতে প্রিয় দুটো শব্দ। কিন্তু এই জীবনে আর হার্টের ডাক্তার হওয়া হলো না। শুধু মার কথা মনে হলে একটু খারাপ লাগে।

আমার মনে হয় বাংলাদেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের স্বপ্ন পুরনের সম্ভাবনা খুব কম থাকে। মেয়েরা যে স্বপ্ন দেখে না তা কিন্তু নয়। পারিপার্শ্বিকতা মেয়েদের অধিকাংশ স্বপ্ন পূরন হতে দেয় না।

তোমাকে নিয়েও তো আমার অদ্ভুত সব স্বপ্ন ছিল। ঠিক যখন স্বপ্নের কথা বলতে যাব তখন শুনি তুমি নেই। বলা নেই কওয়া নেই একদিন হুট করে লাপাত্তা। তোমার বন্ধুর কাছে শুনলাম জরুরি ভিত্তিতে জয়েনিং লেটার নিয়ে তোমার এলাকার কোন এক ইউনিয়ন হেলথ কমপ্লেক্সে জয়েন করতে গিয়েছো।

কি যে রাগ হয়েছিল তোমাকে বুঝাতে পারবো না। তবে রাগের চেয়ে কষ্ট, অপমান আর অভিমান হয়েছিল বেশি। ঠিক সেইসময় আমার শশুর মশাই প্রস্তাব নিয়ে হাজির। অনেকটা রাগ করেই রাজি হয়েছিলাম। শুধু মনে হয়েছিল আমার জন্যে তোমার সামান্য কোন টান নেই। টান থাকলে এভাবে না বলে কেউ কি কখনও যায়??

তুমি একবার লিখেছিলে আমাকে নাকি তুমি ভীষন পছন্দ করতে। এটা অবশ্য তুমি না লিখলে আমি কোনদিনই জানতে পারতাম না। লিখেছিলে আমার বাবা মা রাজি হবে না বলে তুমি আর কোনদিন এইদিকে চিন্তা করোনি। বলার সাহসও করোনি। তবে এটা ঠিক যে তুমি তখন বেকার ছিলে। তাছাড়া তোমার আর আমার পারিবারিক স্টাটাসের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল।

তারপরও তুমি যদি একটু আভাস দিতে অথবা আমি যদি একটু আঁচ করতে পারতাম যে তুমি আমাকে ছিঁটেফোটা পছন্দ কর। তাহলে তোমাকে আমি কোনদিনই ছাড়তাম না। রাগ করে বিয়ের পিঁড়িতে আর বসতাম না। অন্তত বাবা মাকে এটাসেটা বুঝিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম।

যাহোক এসব বলে আর এখন কোন লাভ নেই। সৃষ্টিকর্তা আসলে তোমার আর আমার একসাথে নাম লেখেননি।

গতবছর ঠিক এইসময় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অসুস্থ প্যারালাইজড অবস্থায় আমার সাথে দীর্ঘদিন ছিলেন। অসুস্থ এই মানুষটাকে দেখে অন্যরকম এক শান্তি খুঁজে পেতাম। বাবার সেই অসুস্থ মায়াময় চেহারাটি সারাক্ষণ চোখের সামনে ভাসে। বাবা চলে যাবার পর এখন আর কাউকে দেখে অমন শান্তি খুঁজে পায় না। আর এখনতো আমার কেউ নেই। বাবা নেই মা নেই। বলতে পারো এখন আমি এতিম।

তুমিতো আমার ফেসবুক লিস্টে আছো। আমাকে নিশ্চয়ই দেখেছো। আচ্ছা আমার চেহারাতে কি কোন বয়সের ছাপ পড়েছে? সেদিন আমার এক ট্রেনার ভেবেছিল যে আমি তার চেয়ে ছোট। তার বয়স পয়ত্রিশ। আমি চুপ করে ছিলাম। কোন মন্তব্য করিনি। তার ভুলও শুধরে দেয়নি।

ও আর একটা কথা। সে বলল, আমি নাকি দেখতে পুতুলের মত। তবে আমি জানি সে একটু বেশি বেশি বলেছে।

আমার সুবিধা হচ্ছে এখনও আমি ছোটখাটো ব্যাপারে অনেক হাসতে পারি। যেটা একটা বয়সের পর বেশিরভাগ মানুষ পারে না।
এখানকার টিনএজদের জীবন খুব কঠিন, বিশেষ করে মেয়েদের। এইজন্য পঁচিশ বছরের আগ পর্যন্ত মেয়েরা খুব সুন্দর। তারপর চেহারার উজ্জ্বলতা হারিয়ে যেতে শুরু করে। সেই তুলনায় আমাদের দেশের মেয়েরা অনেক ভাল।

শোনো তোমাকে আর একটা কথা বলি। মেজাজ মন কোনটাই খারাপ করবে না। তবে যেটা সত্যি সেটাই বলছি। তোমাকে বললে আমার ভালো লাগবে সেইজন্য বলছি।

যেদিন তোমার সাথে রিকশা করে বাইরে গিয়েছিলাম সেদিন খুব নার্ভাস ছিলাম। সম্ভবত এটা তোমাকে আগেও একদিন বলেছি। খুব করে মনে হচ্ছিল তুমি আমার হাতটি ধরো। ওইসময় সত্যি খুব টেনশান হচ্ছিল। সেদিন তুমি যদি সত্যি আমার হাত ধরতে আসলে তখন আমি কি করতাম? রিকশা থেকে পড়ে যেতাম নাতো??
টেনশন লাগছিল সত্যি তবে আমি কিন্ত খুব আশাও করেছিলাম।

তবে তোমাকে আর একটা কথা বলি। সত্যি কিছু মনে করোনা। ভয়ংকর জিনিস কি জানো? সেই ফিলিংসগুলার এখনও তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। আগে যা ছিল তাই ই আছে।

তোমার সাথে যতবার সামনাসামনি দেখা হতো, কথা হতো নিজেকে খুব অপ্রস্তুত মনে হত। নার্ভাস লাগতো। তোমার সাথে দেখা হলে অনর্গল তাড়াতাড়ি কি সব জানি কথা বলতাম। তবে এটাও ঠিক যে আমি খুব টেনশানে কিংবা খুশি থাকলে তাড়াতাড়ি কথা বলি।

মাঝে মাঝে আমি নিজেও বুঝতাম না আমি কি বলছি। তোমাকে তো বেশি বলতেও দিতাম না। তবে এখন খারাপ লাগে। তোমার কথা আরেকটু শোনা উচিত ছিল। তাহলে তোমার আরও কিছু স্মৃতি আমার কাছে থাকতো। এমনিতেই তোমার সাথে আমার খুব বেশি স্মৃতি নেই। এক বছরে আর কতটুকুই বা স্মৃতি থাকে??

একদিন যে সত্যি সত্যি বয়স হবে ওইসময় এসব মাথায় আসতো না। আমার কল্পনাতে ছিল তুমি কখনও বুড়া হবেনা। অথচ দেখো তুমিও বুড়া হয়ে গেছো। চুলের প্রায় অর্ধেকটা পেকে গেছে। চশমার গ্লাসটা ভারী হয়েছে। মাথার চুলগুলো কমে এসেছে। এসব কিন্ত আমার কল্পনাতে ছিল। তবে তুমি যে কখনও মোটা হতে পারবে এটা আমার মাথায় ছিলনা।

ইদানিং না খুব বেশি ইচ্ছে হয় তোমাকে সরাসরি দেখতে।যাহোক আমাদের বোধহয় আর কোনদিন সত্যিই দেখা হবে না।

আরও একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। সেটা কি জানো? কোন এক সূর্য ডোবার মুহূর্তে পুকুর কিংবা নদীর পাড়ে বসে থাকবো। আর আমি শুধু অনর্গল কথা বলবো। তোমার কিছু বলার দরকার নেই। তুমি কেবল শুনবে।

তবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল জিনিসটা হতো যদি তোমার সাথে আমার দেখা না হতো। শোনো আমি কিন্ত খুব বড়সড় লেখা লিখতে বসেছি। মোঘল ইতিহাস বলতে পারো। তুমি আবার খেই হারিয়ে ফেলছো নাতো??
তবে এই পর্যন্ত যদি পড়ে থাকো তবে ধন্যবাদ। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়া শুরু কর।

মাস তিনেক আগে তোমাকে আমার একটা সমস্যার কথা লিখেছিলাম। তোমার হয়তো মনে নেই। মনে না থাকবার ই কথা। এত ব্যস্ত একজন মানুষ তুমি। মাঝেমাঝেই আমার খুব মাথাব্যথা হত। সেই ব্যথাটা মাসখানেক ধরে খুব বেশি। এতদিন নিজে নিজে ডাক্তারী করতাম। মাথাব্যথা কমানোর জন্য পেইন কিলার খেতাম। ইদানিং পেইন কিলারেও কোন কাজ হচ্ছে না।

গত সপ্তাহে জোর করে আমার হাজবেন্ড এখানকার এক ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার দেখে এমআরআই করার পরামর্শ দিলেন।

রাশেদ, তুমি কি টের পাচ্ছো আমার কি হয়েছে? জানো, আমার এমআরআই রিপোর্ট ভাল আসেনি। খুব খারাপ একটা রিপোর্ট এসেছে। ওরা আমাকে বলতে চাইনি। কিন্ত আমিতো ঠিকই রিপোর্ট দেখে ফেলেছি। আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে।

আমার হাজবেন্ডের ভীষণ মন খারাপ। বেচারা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। গত পরশুরাতে সে এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। আমি না অতটা প্রস্তুত ছিলাম না। কোন কথা নেই বার্তা নেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না। স্বল্পভাষী মধ্যবয়সী দায়িত্বশীল পুরুষেরা যে কখনও এভাবে কাঁদতে পারে আমার জানা ছিলনা। বেচারি নন মেডিকেল মানুষ। আমাকে সান্তনা দিচ্ছে যে আমার নাকি কিচ্ছু হয়নি।

কিন্ত রাশেদ, আমি তো জানি আমার কি হয়েছে। আমার টিউমারটা খুব বেশি সুবিধার না। ডাক্তারদের এই এক সমস্যা। যা জানার আগেভাগে জেনে যায়। ডায়াগনসিস একটু দেরি হওয়াতে টিউমার তার নিজস্ব গতিতে বেশ দুর এগিয়ে গেছে। আমি আমার হাজবেন্ডকে চিনি। সে তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে যাবে।

এখন আমার সামনের দিনগুলোতে চিকিৎসা রিলেটেড ভয়ংকর কিছু যন্ত্রনা অপেক্ষা করছে। চিকিৎসার ওই ভয়াবহ যন্ত্রনার চেয়ে হুট করে মরে যাওয়াটা অনেক ভাল। আমার মনে হয় ক্যান্সার রুগীদের এইসব সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির কষ্ট না দিয়ে একটা ইনজেকশন পুশ করে মেরে ফেলাটা অনেক ভাল।

তুমি আমার জন্য এই দোয়াটা এট লিস্ট করো। যাতে আমি ভয়ংকর এইসব যন্ত্রনা পাবার চেয়ে হুট করে মরে যেতে পারি।

সবচেয়ে মজার বিষয় কি জানো? আমার ছেলেটা এখনও কিচ্ছু জানে না। সে শুধু জানে যে তার মায়ের মাথাব্যথা আগের চেয়ে বেড়েছে। তার এখন শুধু একটাই কাজ। আমার কাছে বসে আমার কপাল টিপে দেয়া। ইদানিং আর একটা নতুন যন্ত্রনা শুরু করেছে। কপাল টিপে দেয়া শেষ হলে নাকে মুখে চোখে সবখানে একসাথে চুমু খাবে।

রাশেদ, আমার এখন শুধু একটাই কষ্ট। সেটা হলো আমার ছেলেটা। কেবল ওর দিকে তাকিয়ে আরও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। এখন আমার প্রান্ত ছাড়া আর কারো জন্য তেমন কষ্ট হয় না। এমনকি তোমার জন্যেও না।

শোন, তুমি কিন্ত সান্তনা দেবার জন্য আমাকে কোন মেইল করবে না। এই মুহুর্তে নতুন করে আর কোন কষ্ট পেতে চাই না। তোমার লেখা দেখলে হয়তোবা আরও কষ্ট বাড়বে। এমনও তো হতে পারে আরও বেশিদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে। সো তুমি আমাকে কোনকিছুই লিখবে না। কোন যোগাযোগ করারও চেষ্টা করবে না। এটা আমার রিকোয়েস্টও বলতে পারো। আর আমার মত এমন অসুস্থ মানুষের রিকোয়েস্ট নিশ্চয়ই তুমি শুনবে। সম্ভবত তোমার কাছে পাঠানো এটাই আমার শেষ মেইল।

ও আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। তুমি একটু রাত কম করে জাগবে। তোমার চোখের নীচে কালি পড়েছে। তবে কালি পড়ুক আর ছাই পড়ুক তুমি কিন্ত আমার কাছে সেই একই প্রতিচ্ছবি। হালকা পাতলা গড়নের হাসিখুশি চশমাপরা রাশেদ। ভালো থেকো। অন্তত এই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ যতটুকু ভালো থাকা যায়।

– তামান্না / তিন্নি (আমার মা কিন্ত আমাকে সবসময় তিন্নি নামে ডাকতো)”

রাশেদ পড়া শেষে এক নিমেষে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে তামান্না হাসপাতালের ধবধবে সাদা চাদর মোড়ানো বেডে তার সামনে শুয়ে আছে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাওয়াতে মাউস খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। রাশেদের বুকটা ভীষন ভারি ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা তার বুকের উপরে চেপে বসেছে।

রুমের দরজা খুলে ওয়ার্ড বয় এসে বলল, স্যার অফিস তো শেষ। আপনি বাসায় যাবেন না?
তুমি যাও। আমার কাছে চাবি আছে। আমি দরজা লক করে চলে যাব।

প্রায় এক মাসের আগের মেইল। তাহলে তামান্নার অবস্থা এই মুহূর্তে কেমন? রাশেদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তামান্না কেমন আছে? কিভাবে জানবে সে? হঠাৎ করে বন্ধু সরোয়ারের কথা মনে হলো। দীর্ঘদিন হয়ে গেল টরেন্টো তে থাকে। তামান্নার সাথে নিশ্চয় ওর যোগাযোগ আছে।

বেশকিছু সময় চেষ্টার পর সরোয়ারকে খুঁজে পেল। সম্ভবত ওখানে রাত একটা। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওপাশ থেকে বলল, তামান্নার কথা জানতে চাচ্ছিস নিশ্চয়। সরি দোস্ত, তা প্রায় দশদিন হতে চললো ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। ওর ছেলেটার জন্য দোয়া করিস দোস্ত।

কোন কথা না বলে রাশেদ ফোনটা কেটে দিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ভেজা চোখদুটো লাল হয়ে আছে। আজ বিকেলে রাশেদ কোথাও যাবে না। কোথাও না। হাসপাতালের এই বন্ধ রুমে সে আরও কিছুসময় থাকবে। যতক্ষন না চোখের পানি পুরোপুরি শুকিয়ে না আসে।।


প্ল্যাটফর্ম ফিচার/সামিউন ফাতীহা

ওয়েব টিম:

View Comments (1)

Related Post