X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে ফোর্টিন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ এপ্রিল ২০২০, সোমবার:
ডা. শুভদীপ চন্দ

আজ আমি গৃহবন্দী। ডে অফ কাটাচ্ছি। পাশের ফ্ল্যাটের চার-পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে আমাদের একতলা নিচে থাকা তার বান্ধবীকে ডাকছে ‘রা-জে-শ্ব-রী… ও রা-জে-শ্ব-রী….’! রাজেশ্বরী বড় হবে, কিন্তু এতো সুন্দর করে এতো ভালোবাসা নিয়ে এ পিচ্চির মতো মনে হয় আর কেউ ডাকবে না। মনে হচ্ছিল ‘রাজেশ্বরী’ শব্দটি তৈরিই হয়েছে শুধু এ কন্ঠে উচ্চারিত হবার জন্য। দুই বান্ধবীর কিছুক্ষণ শলা পরামর্শ শুনলাম। প্রতিদিন নাকি এ পর্ব চলে!

কোভিড উনিশ। আমাদের লকডাউনের চৌদ্দতম দিন। চীন তার দুঃসহ দিন পার করে ফেলেছে, ইতালি ও স্পেনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, আমেরিকায় সংক্রমণ কমছে, ভারতে কোথাও কোথাও লকডাউন শিথিল হয়েছে। আমরা জানি না আমরা ঠিক কোথায় আছি। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

এখন আমরা এমন এক পৃথিবীতে যেখানে আমাদের আকাশ এক, কিন্তু প্রত্যেকের দাঁড়ানোর গ্রাউন্ড আলাদা। কারো জন্য নরম মাটি, প্রতিদিন বাহারি রান্না- হৈ-হুল্লোড়- আনন্দ। কারো জন্য কঠিন সময়। রোগী নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া। একাকীত্ব। কোনোভাবে সময় পার করে দেয়া। কেউ হয়তো আসছে রমযান মাস নিয়ে উৎফুল্ল, কেউ ভাড়ারে চাল নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আর মাত্র দুইদিন চলবে!

কেউ মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে কিটো ডায়েটে যাচ্ছেন, ভিনেগারের বোতল ঘরে জমিয়ে রাখছেন। কেউ আস্তাকুঁড়ে এ নজর রাখছে আজ ভাল কিছু পড়লো কিনা। কেউ বলছে ‘ক্ষুধায় মরবো, তুলে দাও লকডাউন’। কেউ বলছে ‘যারা বের হচ্ছে তাদের পায়ে গুলি করো’। কেউ লকডাউনের সমাপ্তি চায় কক্সবাজার ঘুরতে যাবে বলে। কেউ সমাপ্তি চায় এভাবে আর চলছে না বলে।

কারো মতে এ দেশ “তামাতামা” হয়ে যাবে মানুষ মরে। কারো মতে ইউরোপ আমেরিকার কাছাকাছি কিছুই হবে না। কেউ ডাক্তারের পক্ষে, কেউ ডাক্তারদের বিপক্ষে। কেউ সরকারকে সাধুবাদ দিচ্ছে, কেউ গাল পেরে সরকার ধ্বসিয়ে দিচ্ছে। কেউ প্রতিদিন নুডুলস খাচ্ছে, ভর্তা খাচ্ছে। কেউ নতুন নতুন রান্না শিখছে। কেউ দান করে খুব খুশি কিংবা ফেসবুকে লিখে। কেউ মাথা নিচু করে লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছে- কেউ চিনে ফেলছে না তো!

কেউ আক্রান্ত, কেউ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ, কেউ ঝুঁকিগ্রস্ত, কেউ মৃত। কেউ কোয়ারেন্টাইনে, কেউ আইসোলেশনে, কেউ হাসপাতালে, কেউ ফেসবুকে। কেউ জানালা দিয়ে আকাশ দেখে দেখে বিরক্ত, কেউ থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা দেখে সন্ত্রস্ত। কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখছে, কেউ বিজ্ঞানে। কেউ বাড়িতে অফিস করছে, কেউ অফিসেই বাড়ি বানাচ্ছে। কেউ শুধু অতীতের গল্প করেন, কেউ করেন ভবিষ্যতের গল্প।

সবাই সবার গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। এতবড় আকাশ, এত পার্থক্য চোখে চোখে- যে আকাশের মানে তো বদলাবেই।

কোভিড উনিশ আপনাকে ভাবতে শেখাবে। অন্যের জায়গায় নিজেকে বসাতে শেখাবে। এ শিক্ষাটি অনবদ্য। সবাই সবার পজিশনে রাইট। গতকাল ডাক্তার বলে যে আমাকে বাইকে তুলে নি- তাকে আমি দোষ দেই না। যে মালিক দূর থেকে চাবি ফেকে দেয়, তার বিরুদ্ধেও কমপ্লেন করি না। গায়নী ডাক্তারের পালিয়ে যাওয়া যেমন ঠিক, তেমনি তাকে কসাই গালি দেয়াও ঠিক। সবাই সবার গ্রাউন্ডে ঠিক।

রাজেশ্বরীর নামটিই কেবল জানা হলো। ও পাশের পিচ্চিটার নাম জানা হলো না!
আবার ডাকছে ‘রা-জে-শ্ব-রী… ও রা-জে-শ্ব-রী….’
‘রা-জে-শ্ব-রী….. ’!!

Platform:
Related Post