X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে নাইনটি ফোর

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ জুলাই ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

মহাভারত টিভি সিরিয়ালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- ‘শৃগাল যখন হাতির পিঠে চড়ে সোর করে সে হাতির বলেই করে; হাতি সেখানে দায়ভার এড়াতে পারে না।’

ছবি – প্রতীকী

মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ডাকসাইটে সাংবাদিক সবাই ছবি তুলেছেন একজন শাহেদের সাথে। এখন কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না। বলছেন- ‘ছবি তুলতে গেলেই চিনতে হয় না’। জ্বী না, আপনারা রকস্টার নন। সেলিব্রেটি নন। একজন টিভি স্টারের ভক্ত যে কেউ হতে পারে। আপনারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আদর্শ নিয়ে কাজ করেন, দায়িত্বের কারনে পরিচিত ফেস। আপনাদের ভক্ত কেন এমন চোর হবে। ইনি আপনাদের ঘরোয়া পার্টিতে যানই বা কিভাবে। যিনি আলু পটল বিক্রি করেন- মেহনতের পয়সায় খান- তাকে কী সুযোগ দিবেন আপনাদের জলসায় ঢোকার? তারা তো দূর, কোনো অফিসিয়াল প্রয়োজনে আমরাই তো পারবো না আপনাদের চেম্বারের আশেপাশে যেতে। যে শিয়াল হম্বিতম্বি করলো সে আপনাদের জোরে।

ভাবা যায় এ মহামারীর দিনেও এ লোকগুলোর পকেট কাটা বন্ধ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে এর ভাগ সবাই পায়। তাই ছবি উঠেন সবাই। ছবি সাক্ষ্য দেয় তারা তার পাশে আছেন। ইতালি পাঠানো হলো কোভিড নিগেটিভ সার্টিফিকেট দিয়ে, প্লেন থেকে নামামাত্র অনেকে পজিটিভ! একজন সংসদ সদস্য মানব পাচারের অভিযোগে অন্য এক দেশে কারাগারে আছেন। এ দেশ নিয়ে যখন কেউ বড় বড় কথা বলে, তাকে ধান্দাবাজ ফোল্ডারে রেখে দেয়া যায়! সে নিশ্চয়ই কিছু একটা বিক্রির ধান্দায় আছে। পরিষ্কার ভাষায়- হয় সে ধান্দাবাজ নয় সে অন্ধ।

কোভিড উনিশ আমাদের পুরো সমাজের সামনে এক দর্পণ তুলে ধরেছে। সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে লুটেরাদের চেহারা, ভাগ পাওয়া সুবিধাভোগীদের চেহারা, নন্দলালদের চেহারা, বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া কুবেরদের চেহারা। কেউ কিছু বলবে না- কারন সবাই আপসে ভাল আছে। তলে তলে সবাই তার আখের গোছাচ্ছে বিদেশ পাড়ি দেবার জন্য।

পাঁচ ছয়শো বছর আগে দস্যুরা তাদের দেশ থেকে এ দেশে এসে এদেশের যত না ক্ষতি করেছে, এ দেশ থেকে তাদের দেশে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়ে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে গেছে। এখানে কেউ পালাচ্ছে ভবিষ্যৎ থেকে, কেউ পালাচ্ছে দায়বদ্ধতা থেকে, কেউ পালাচ্ছে অযোগ্যতা থেকে, কেউ পালাচ্ছে পাপ থেকে।

এক দিল্লিতেই প্রতিদিন বিশ হাজারের উপর টেস্ট হচ্ছে। ভারত ডেটলাইন দিচ্ছে পনেরো আগস্টের আগেই ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ব্যাপারে। দিল্লি আমাদের চেয়ে বেশি দূর নয়। দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে আমাদের মন মানসিকতায়। আমরা আছি কে কার সাথে শোবে তা নিয়ে। সম্পূর্ণ ইউরোপ আমেরিকা বিশ্ব একটি প্ল্যান নিয়ে এগোচ্ছে। আমরা কোথায়?

সমস্যা হচ্ছে ঘৃণার থু থু টা মুখে এসে আটকে থাকে। ফেলা যায় না কারো মুখে। হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ রাজের সময় কিংবা পাকিস্তান প্রিয়ডে এরচেয়ে বেশি স্বাধীনতা পেতেন। থুথু টা জায়গা মতো ফেলতে পারতেন- অন্তত নিজের ঘরে, নিজের ওয়ালে। একটু হলেও শান্তি পেতেন।

আমার মেডিকেলের এক জুনিয়র আজ রোড একসিডেন্ট এ মারা গেছে। ফেসবুকে খবরটা পড়ার পর থেকেই মনে শান্তি পাচ্ছি না। ছেলেটার মুখে এক ট্রেডমার্ক হাসি ছিল। পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশন কোর্সে ছিল। হয়তো আর কিছুদিন পরই তার কমপ্লিট হয়ে যেতো। হয়তো আর কিছুদিন পরেই সে তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলতো। সব শেষ করে চেম্বারে বসতো। রোগী দেখতো নিজের মতো করে।

ডাক্তারদের জীবন কত পরে শুরু হয়। অন্যরা যখন ভার্সিটি শেষ করে রাস্তায় পা দেয়, ডাক্তাররা তখন আরেক বিল্ডিংয়ের দরজায় স্যান্ডেল খুলে অপেক্ষায় থাকে- ঢোকার জন্য। আবার প্রসেসিংয়ের জন্য। আবার ছাত্রত্ব, আবার পরীক্ষা। স্বাধীনভাবে রাস্তায় বাঁচা অনেক দূর।

মৃত্যু যেন এক অদৃশ্য দরজা। যার সময় আসে তার দরজা খুলে যায়। সে ঢুকে যায় আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বেশি দরজা মহাসড়কে, হাসপাতালে। স্মৃতি সব পড়ে থাকে অনর্থক। আদিলের মৃত্যু আমাকে কাঁদায় না, ভাবায়। কী লাভ এতোকিছু করে। জীবন যেখানে অনিশ্চত। হয় রোড ট্রাফিক একসিডেন্ট, নয় ভুয়া করোনা টেস্ট, নয় দুই নম্বরি মাস্ক, নয় ভুয়া লঞ্চ ড্রাইভার। অপমৃত্যুই নিয়তি।

যে পর জগতে তুই বিশ্বাস করিস, সেখানে ভাল থাকিস ভাই।
আমরাও আসছি।

Platform:
Related Post