X

লাইফ ইন লকডাউন, ডে টুয়েন্টি ফোর

১ মে ২০২০, শুক্রবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

আজ আমার ডিউটির শেষদিন। আগামীকাল থেকে কোয়ারেন্টাইন। আজ একটি মাস্ক পেলাম- কেএন 95। সেও ‘পেয়েছি’ বলা ভুল হয়, আদায় করে নিয়েছি। কোভিড উনিশ যদি আরো বিশ দিন রাজত্ব করে, আবার দেখা হবে।

কথা হচ্ছিলো এক এক্টিভিস্টের সাথে। আমাদের ডাক্তারদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন এক্টিভিস্ট প্রজাতির। তারা ডাক্তারদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। কোথাও ঝড়ে খুঁটি নড়ে গেলে তারা গাঁটের পয়সা খরচ করে মই নিয়ে চলে যান; ‘সারাই’ করবেন বলে। প্লাটফর্ম ও বিডিএফ- এরকম কিছু বোকা লোকদের সংগঠন! তারা তাদের পেশাকে তাদের ভবিষ্যতের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। বললেন- আক্রান্ত ডাক্তার পাঁচশো ছুঁইছুঁই, মানসম্মত মাস্ক চাওয়ায় এক পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, এ রোযার দিনে চিকিৎসা কর্মীরা কিভাবে থাকছে কিভাবে খাচ্ছে- সঠিক কেয়ার নেই। বলছিলেন তিনি দামী মাস্ক, ফেস শিল্ড, পিপিই কিনেছেন; পরেন না। আমি বললাম ‘কেন?’ বললেন- ‘আমাদেরও অভিমান হয়’!

এ অভিমানের চোটেই কিনা, করোনা সন্দেহের রোগীগুলোকে নন কোভিড হাসপাতাল নিচ্ছে না। আবার শুধু সন্দেহের বশে কোভিড হাসপাতালও নিচ্ছে না। ফলাফল তারা ঘুরছেন। অনেকে বিনা চিকিৎসাই মারা যাচ্ছেন। লোকের স্বভাবই হচ্ছে নিজের সুখ দুঃখকে বড় করে দেখা। যেমন সমুদ্রের ধারে গিয়ে সূর্যকে দুই আঙ্গুলে নিয়ে ছবি তোলে! সামগ্রিক অসন্তোষের চেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষ যুক্ত হয়ে বড় রূপ ধারণ করছে। ফলে অসন্তুষ্ট সবাই। যে ভাল আছে, যে খারাপ আছে, যে খারাপ নেই- সবাই।

এদিকে লকডাউন শহরে নতুন রুটিন চালু করেছে। সন্ধ্যা সাতটার দুঃখ শহর সকাল সাতটায় পুষিয়ে নিচ্ছে। শুনেছি একদম ভোরে অনেক দোকান খুলে। গদির দোকান, মোবাইলের দোকান, গাড়ির পার্টসের দোকান, বা ইলেকট্রনিকসের দোকান। আসলে কোনটি যে ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ নয় বলা কঠিন!

আজ এক বেশি কথাবলা রিকশাচালকের রিকশায় উঠেছিলাম। বলছিলো- এ লকডাউনের দিনে সে কিভাবে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে চলেছে। আজ পর্যন্ত একদিনও ধরা পড়ে নি। কোথায়-কখন-কোন রাস্তায় পুলিশ পাহাড়া বসে সব তার নখে দর্পণে। তেমনি এক অভিজ্ঞ রোগী এসেছিল। উনার দক্ষতা মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার। হার্টে তিনটি রিং, বাইপাস অপারেশন সাথে গল ব্লাডার কেটে ফেলার প্রমাণ দিয়ে তিনি বিজয়ের হাসি হাসলেন। এখন সমস্যা- কনস্টিপেশন। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ করোনার চেয়ে কনস্টিপেশন নিয়ে বেশি চিন্তিত। হাতে মশলার গন্ধ, নখে হলুদের দাগ, আঁচল দিয়ে নাক ঢাকা এক মাঝবয়েসী মহিলা এসেছিলেন। উনার সমস্যা সুগার হাই। এক মাস পর আবার আসতে বলায়, কাজ ফাঁকি দিয়ে আসতে তার অনেক কষ্ট হয় বললেন। এ করোনায় সবাই কমবেশি ছুটি পেয়েছে, শুধু রান্নাঘর পায় নি। উল্টো তাদের বোঝা বেড়েছে।

কেএন ৯৫ মাস্কের প্যাকেটে লেখা দেখছিলাম- ‘উই আর দ্যা ওয়েভস অফ দ্যা সেম সী, পিপলস অফ দ্যা সেম আর্থ’। ভাল কথা লেখার জন্য স্থান-কাল-পাত্র লাগে না। যে মাস্ক সবাইকে আলাদা আলাদা নৌকায় উঠাচ্ছে, নিজের শ্বাস নিজেকে গেলাচ্ছে, সেও বলছে- ‘উই আর দ্যা ওয়েভস অফ দ্যা সেম সী…!’

এক আফসোস ছিল- সামনের বিশদিন আসবো না, ধান কাটা দেখা হবে না। কারন এখন ধান কাটা হচ্ছে হাওড় অঞ্চলে। এদিককার সব ধান পাকেও নি। আজ সকালে দেখি স্থানে স্থানে ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। এ ধান গাছ গুলো চোখের সামনে বুনতে দেখেছি। প্রথমদিকে পানিতে ঢেকে থাকতো। বড় হতে দেখেছি। অল্পঅল্প করে সোনালি হতেও দেখেছি। কাটা না দেখলে অপূর্ণতা থেকে যেত। এমনকি জমি তৈরি, বীজতলা তৈরি, গতজন্মের সরিষাক্ষেতও দেখেছি!

দেখলাম ধানগাছ কেটে আঁটি আঁটি করে রাখা হচ্ছে। এক মাঠ কাটার পর সেগুলো মাথায় করে রাস্তার ধারে আনা হলো। সিমেন্টের স্যুয়ারেজের পাইপে ঝেড়ে ধান ছড়ানো হলো। হলুদ মৃত গাছও ফেলনা নয়। এক লম্বা বাঁশ দিয়ে জড়ো করে গম্বুজ আকৃতির খড়ের ঢিবি হচ্ছে। এটি আটাশ, অথবা হাইব্রিড ছাব্বিশ। মাঠে যা আছে সব ঊনত্রিশ। ঊনত্রিশই বেশি। এগুলো নাকি বিশ দিন থাকবে না। দ্রুতই সব পেকে যাবে। কেটেও ফেলা হবে।

হাঃ! এখন আর মরতে আপত্তি নেই!! আজ থ্রোট নেসাল সোয়াব টেস্ট দিয়েছি, কাল রিপোর্ট। মন বলছে- নিগেটিভ আসবে।

Platform:
Related Post