X

লাইফ ইন লকডাউনঃ ডে হান্ড্রেড টুয়েন্টি সেভেন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, মঙ্গলবার

ডা. শুভদীপ চন্দ
মেডিকেল অফিসার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স

করোনা এখন শহর পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে গেছে। প্রচুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের জ্বর এবং এক্সরে খারাপ। গ্রামে গ্রামে করোনা ছড়িয়ে পড়লে সর্বনাশের একশেষ হবে।

ছবিঃ ডা. শুভদীপ চন্দ

কারণ দুইটি। প্রথমত, গ্রামের মানুষ অসচেতন। করোনার চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায়, ততই ভাল। স্টাডি বলছে, তিনদিনের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে কমপ্লিকেশন ছাড়া সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ, সাতদিনের মধ্যে করলে ৯৪ শতাংশ। অষ্টম নবম দিনে কন্ডিশন খারাপ হতে থাকে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, স্যাচুরেশন ফল করে। গ্রামের মানুষ সেসময় আসে। যখন অক্সিজেন দেয়া ছাড়া খুব বেশি কিছু করার নেই। আর দ্বিতীয়ত, সুযোগ সুবিধার অভাব। আমি দুই এন্টিভাইরাল এ উপজেলায় কোনো ফার্মেসিতে পাই নি। অক্সিজেনের স্বল্পতাও আছে, আছে মনমানসিকতায় সমস্যা। এক নেতা ভর্তি ছিলেন। উনাকে দেখতাম প্রয়োজন ছাড়াই অক্সিজেন নল নাকে লাগিয়ে রাখতেন। অথচ তার হাসপাতালে ভর্তি থাকারই প্রয়োজন নেই। সিলিন্ডার কয়টি আছে, এক সিলিন্ডারে কতদিন যায়, কোনো বিচার বিবেচনা নেই। গ্রামের মানুষ, বিশেষত নেতারা মারাত্মক ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়।

করোনার আড়াইটার বুলেটিন প্রকাশ বন্ধ। এতোদিন ধরে এক আগ্রহ কাজ করতো। যদিও জানতাম এগুলো ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্য দেশে কেস বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে টেস্টও বাড়িয়েছে। আমরা বাড়াই নি। করোনা সংক্রান্ত খবর এখন পেছনে ছাপা হয়। যুদ্ধ এখন সীমাবদ্ধ শুধু পরিবারগুলোয়, যারা আক্রান্ত। ইতিহাসে লেখা থাকবে, আমরা স্বাস্থ্যবিধি বলতে মোবাইলে রেকর্ডেড কথাই বুঝেছিলাম। যা গত পাঁচ ছয় মাস ধরে অনবরত বেজেই গেল!

স্বাস্থ্যের নতুন ডিজিকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ করা হয়েছে। ডাক্তার কমিউনিটি এখন সবকিছু নিয়ে দিশেহারা। প্রণোদনার এক মূলো ঝুলছে বহুদিন ধরে। কিছুক্ষণ আগে আমার এক কলিগকে তার বাবা মা সহ ঢাকায় পাঠালাম। দুজনেরই জ্বর ছিল, এখন স্যাচুরেশন ফল করছে। যখন সে গাড়িতে উঠে তখনও সে জানে না কোথায় নিয়ে যাবে! তিনদিন আগে এক রিপোর্ট দেখেছিলাম, পুরো ভারতে ডাক্তার মারা গেছেন ১৯৬ জন, যাদের ১৭০ জনের বয়স পঞ্চাশের উপরে। আমি এমন দেশের কথা বলছি যেখানে প্রতিদিন এখন ষাট হাজারের উপর আক্রান্ত হচ্ছে। আর আমাদের ডাক্তার মারা গেছেন একশো জনের বেশি। যেখানে সরকারি হিসেব মতে আমাদের কনফার্ম কেস প্রায় ২,৬০,০০০। তুলনামূলক অবস্থা কত ভয়াবহ ভাবা যায়! অথচ আমরা ডাক্তাররা এখনো জানি না বাবা মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে কোথায় নিয়ে যাব!

রাশিয়া ভ্যাক্সিন আবিস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ‘ভাইরাস’ প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন রাশিয়ানরাই। ১৮৯২ সালে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ দেশটির জনসংখ্যা ১৪ কোটি। আমাদের চেয়ে কম। যদি ঈশ্বর মানুষের মতো হতেন আমাদের জন্মকে অপচয়ের খাতায়ই রাখতেন! আমরা জন্মই নিয়েছি পৃথিবীর বোঝা বাড়ানোর জন্য। ভ্যাক্সিন আবিস্কারের দৌড়ে নেই বলে বলছি না, আমরা তো কোনো দৌড়েই নেই। তবে রাশিয়ার এ ভ্যাক্সিন নিয়ে বিতর্ক আছে।

মাঝে কয়েকদিন ওসি প্রদীপকে নিয়ে তোলপাড় হলো। উনার কাহিনী যেকোনো সিনেমার ভিলেনের চেয়েও ভয়ংকর। কিন্তু পৃথিবীতে কী কোনো এমন ‘প্রদীপ’ আছে, যা এমনি এমনিই জ্বলে? যতদিন না তেলের যোগান বন্ধ হচ্ছে এসব প্রদীপ নিভবে না। তবে আসল আঘাতটি গেলো বিশ্বাসের উপর। আগে বলতো, সাপের সাথে এক বাসায় থাকা চলে, পুরনো চোরের সাথে এক পাড়ায় থাকা চলে না। এখন পুরনো চোরের সাথে তাদের নামও নিতে হয়। ভয় লাগে। মৃত্যুর ভয় নেই, কলঙ্ক নিয়ে মরতে ভয় লাগে!

আরেকটি খবর পড়লাম। ভূতূড়ে বিলের খবর। মনে পড়ে এ কিছু সপ্তাহ আগে আমার বাবা বিল দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি উনি। কম্বাইন্ড বিল চার পাঁচ গুণ বেশি এসেছিল। বলছিলেন এ টাকা দিতে গেলে স্টাফদের বেতন বোনাস আটকে যাবে।

আমরা বলেছিলাম,

“আগেই সতর্ক হওয়া দরকার ছিল, মিটার তো এমনি এমনি ঘুরে নি। আজ জানলাম- যাদের উপর দায়িত্ব তারা বোনাস পাওয়ার লোভে ভূতূড়ে বিল বানিয়ে বানিয়ে দিচ্ছিলেন। হোমড়াচোমরা কারো শাস্তি হবে না জানি, কিন্তু ওদের মুখে যে থু থু ফেলব, অত থু থু গলায় কই?”

ছবিঃ প্রতীকী।

ডায়েরি লেখা আবার শুরু করলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের আরো অনেককিছু দেখা বাকি। না ভাল লাগলে আবার থামিয়ে দিব। এখন আপাতত লিখে রাখি।

সময় খারাপ। প্রচণ্ড গরম ও অস্বস্তি। তার সাথে নতুন যোগ হয়েছে দুশ্চিন্তা। বৃষ্টি নেই। কিন্তু বন্যার পানি নামছে না। বিকেলে এদিক সেদিক যেতাম সেও বন্ধ। রাস্তা সব ডুবে আছে। আজ বিকেলে রোগী দেখার ফাঁকে শহরে একা একা হেঁটে বেড়ালাম। মাথার উপরে আকাশ আর দূরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আজকাল শ্বাস নিতেও বড্ড ভয় হয়! ভাবি এ শহরটিই কী শেষ শহর হবে কিনা। কত দেশ দেখার যে স্বপ্ন ছিল মনে!

স্বপ্ন তো স্বপ্নই!

Sadia Kabir:
Related Post