X

রক্তাক্ত সিলেটঃ একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

দুপুর সোয়া দুইটা বাজলেই আমার একটু একটু করে মেজাজ গরম হওয়া শুরু করে- যখন ডিরেক্টর অফিস থেকে ফোনে জানানো হলো যে মেডিকেল টিমের অংশ হিসেবে ৩টায় যেতে হবে বর্তমান ন্যাশনাল ক্রাইসিস সিলেটের শিববাড়িতে- মেজাজ পুরা খিচে গিয়েছিল। ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ আমরা দুই কসাই জামাই বৌ-র ২৪ ঘন্টার ভেতর মুলাকাত বলতে দুপুর ৩টা থেকে ৪টা। আর এর ভেতরেই যদি কোন কাজ পড়ে- সেটা যত ইমার্জেন্সিই হোক——। এর আগের দুই দিনই বাসায় পৌঁছেছি ভোর ৪ টায়।

যাই হোক- সাড়ে ৩টার দিকে আমরা ৩ চিকিৎসক আর একজন ব্রাদার মিলে গেলাম ঐখানে। যাদের রিলিভার হিসেবে গেলাম তারা বললেন যে, একশন মনে হয় শেষ- সকালে বিশাল আকারে এটাক হয়েছে। এম্বুলেন্স-এ বসে উৎসুক জনতার নানাবিধ কান্ড কীর্তি দেখে হাসাহাসি করলাম- খানিক পর পর পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে একটু দূরে যায়- আবার জটলা পাকায়-৫ জন সেনা সদস্য মারা গিয়েছে- এক ব্যাটা আর এক বেটিরে মারতে ঢাকা থেইক্যা সেনাবাহিনী আনা লাগে-এমন আরও কাহিনী আর বিশাল বিশাল বিশ্লেষন শুনতে থাকলাম।

কিছুক্ষন পরেই গ্রেনেড এর শব্দ আর কয়েকশ রাউন্ড গুলির শব্দ- এত কাছ থেকে শুনছিলাম- একটু আতংকিততো হচ্ছিলামই। ড্রাইভার বলল যে, সকালে আমাদের গাড়ির খুব কাছ দিয়ে কয়েকটা গুলি গিয়েছে। ডিরেক্টর স্যারকে গালি দিতে লাগলাম- ইমার্জেন্সি টিম দিয়ে পাঠালেনই যখন একটু প্রটেকশন দিয়ে পাঠাতেন- আমরা যে রেঞ্জে ছিলাম সেখানে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছাড়া মানুষ ছিলাম আমরা এই কয়েকজনই- এতোটাই কম দাম কসাইদের???

সন্ধ্যা হতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ‘মশা মারা কেরানি’ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম বিশাল এক সাংবাদিক গ্রুপকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে- একটু খুশি হলাম- হয়ত মিশন কমপ্লিটেড-প্রেস ব্রিফিং হলেই ফিরে যেতে পারব- আজাইরা বসে বসে এতোটাই বিরক্ত হচ্ছিলাম। সাংবাদিকরা ফিরে আসল- হঠাত করেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটা বিকট শব্দ শুনলাম- মানুষের হট্টগোল শুরু হল – আতংকিত হলাম কারণ শব্দটা ঐ বাড়ি থেকে আসে নাই আসছে সেইফ জোন থেকে। একটু পরেই আবারও শব্দ- ভেতর থেকে দুইটা এম্বুলেন্স আসল- আমাদেরটাও এদের ফলো করল- রাস্তায় উঠার সময়ই দেখলাম রক্তের ছোপ ছোপ দাগ- রাস্তা থেকেই একজন আহতকে নিয়ে ছুটলাম মেডিকেলের দিকে।
ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই একের পর এক আহত ঢুকতে থাকল- ইমার্জেন্সি অফিসার ভাইয়াকে একটু সাহায্য করলাম। ইমার্জেন্সির ঝামেলা শেষে গেলাম সার্জারি ওয়ার্ডে- সেখানে কিছুক্ষন থেকে বেশি রোগী না দেখে ওটিতে দৌড় লাগালাম।

ওটি বি ব্লক- লোকে লোকারণ্য- সিনিয়র প্রফেসর, সার্জারির সকল স্পেশিয়ালিটির সকল স্যাররা, সকল ট্রেইনি, ইন্টার্ন এবং কয়েকজন স্টুডেন্ট, নার্স, ওয়ার্ড বয়- ১২টা ওটি টেবিলের সবগুলোতেই সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৩ জন(একজন পুলিশ অফিসার ও একজন কমান্ডিং অফিসারসহ)- কার্ডিয়াক এরেস্টে(হার্ট বিট দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে- শ্বাস নিচ্ছে না)- এনেস্থেশিস্টরা সি পি আর(কার্ডিয়াক ম্যাসেজ) দিচ্ছেন একের পর এক- ঘেমে নেয়ে যাচ্ছেন সবাই- নার্সরা স্যালাইন ওপেন করতেছে- সার্জনরা অপারেশন করতেছেন- ওয়ার্ড বয়রা প্লাস্টার করতেছে- কয়েকজন এটেন্ডেন্ট ক্লিয়ার করতেছে- রক্ত আনা নেয়া করতেছে কয়েকজন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় প্রায় ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় হার্ট আবার বিট দেয়া শুরু করল- এয়ার এম্বুল্যান্সে নিয়ে গেল সিএম এইচে একজনকে- আরেকজনকে অন্য ওটিতে নেয়া হল অপারেশনের জন্য।
ওটি এ ব্লকে দেখি ওখানেও একি অবস্থা- এখানেও একসাথে ৪ টেবিলেই চলছে রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা। সব স্যাররা ইতিমধ্যেই অপারেশন শুরু করে দিয়েছেন। সবার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে অপারেশন রুম থেকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে চলে যাচ্ছিল; নিচে ব্লাড ব্যাংক, সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাবে সমানে সবাই প্রয়োজনীয় রক্ত দিতে লাগল- স্টুডেন্টরাও এসে তাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করতে লাগল।

দুইজনকে নিয়ে এনেস্থেশিওলজিস্ট, সার্জন এবং বাকি সবাই খুব যুদ্ধ করছিল। অপারেশনের মধ্যেই কয়েকবারই কার্ডিয়াক এরেস্টে চলে যাচ্ছিল- আবার একই যুদ্ধ- একদিকে সিপিআর অন্যদিকে অপারেশন। রাত আড়াইটার সময় যখন ফিরে আসি- বিষণ্ণ সবাই-স্যাররাও বিমর্ষ- এতো এতো চেষ্টার পরেও কোন লাভ হলোনা- গত ৬ ঘন্টার এত্তো এত্তোগুলো মানুষের ক্লান্তিহীন চেষ্টাকে বৃথাই মনে হলো-নিহত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ সবার আত্মার সদগতি হোক

ক্লান্তি নিয়েই বাসায় ফিরলাম – কালকে আবার এই নরপিশাচরা হামলা করতে পারে- আবার সেই যুদ্ধ- কালকে আবার আমার ইউনিটেই এডমিশন – একটু ঘুমানো জরুরি।
……
ডাঃ অনুজ কান্তি দাশ

drferdous:

View Comments (5)

Related Post