X

মানসিক চাপ ও স্বাস্থ্য

স্ট্রেস হলো এক কালপ্রিটের নাম, আমাদের শরীরে এমন কোন অঙ্গ নাই যেখানে স্ট্রেসের ক্ষতিকর প্রভাব নাই। অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়া, চুল পেকে যাওয়া, চুল পরে যাওয়া, হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক সহ প্রায় সব কিছুর উপর স্ট্রেসের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে …মেডিটেশন বা বুড্ডিস্ট টেকনিক শুধু মাত্র স্ট্রেস কমানোর জন্যই হাজার বছর ধরে প্রচলিত।
মেডিকেল প্রফেশনাল আর এক স্ট্রেসফুল প্রফেশনের নাম …এ্যামেরিকান টপ টেন স্ট্রেসফুল প্রফেশনের ভিতরে মেডিকেল প্রফেশন ৫ নাম্বারে। এর ভিতরে আবার জুনিয়র ডাক্তারগন স্ট্রেসে বেশি ভুগেন, ৭০% ডাক্তারদের সুইসাইডের কারন স্ট্রেস্ ইন্ডিউসড ডিপ্রেশন. এর ভিতরে আবার ফিমেল ডাক্তারদের সুইসাইডের রেট সব থেকে বেশি।

# স্ট্রেস কি? :
———স্ট্রেস হলো কোন একটা সিচুয়েশনের প্রতি অকারনে, অপ্রয়োজনীয় বেশি বেশি রেসপন্স দেখানো।

# স্ট্রেস কেন হয়? :
————-স্ট্রেস নামক ক্ষতিকর রিয়াকশন কি তাহলে এমনিতেই আমাদের শরীরে হয়?
না, আমরা যখন কোন খারাপ কন্ডিশনে পতিত হই, সেই কন্ডিশনকে ভালো ভাবে ম্যানেজ করার উদ্দেশ্যে আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় এনার্জি ও উপাদান তৈরী করার জন্য শরীরে কতগুলো হরমোনাল ও বায়োক্যামিক্যাল চেইঞ্জ হয়,যা ঐ সিচুয়েশন থেকে ভালো ভাবে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে।
এর আর এক নাম নাম হলো ‘ফাইট এন্ড ফ্লাইট রিয়াকশন ‘।
এখানে আমাদের সিম্প্যাথেটিক এ্যাকটিভিটি বাড়ে, ফলে আমাদের ইভেন্টের প্রতি এ্যালার্টনেস বাড়ে, হার্ট রেট বেড়ে যায় যা শরীরে রক্ত সার্কুলেশন বাড়ায়, রেসপিরেশন বাড়ে যা অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়।

# স্টেসের কি কোন ভালো দিক আছে? :
—————————- একুট স্ট্রেসের সব থেকে ভালো দিক এটি খারাপ সিচুয়েশনকে ভালো ভাবে হ্যান্ডেল করতে সাহায্য করে।
আবার এটা ‘নিউরোনাল প্লাস্টিসিটি ‘বাড়ায় যা লার্নিং ও মেমরাইজেশনে হেল্প করে (আর এই জন্যই পরীক্ষার আগে অনেক বেশি পড়া হয়, এবং সে পড়া মনে থাকে)।

কিন্তু ক্রনিক স্ট্রেস আমাদের শরীরের জন্য সব সময়ই খারাপ.যত ক্ষতিকর দিক আছে সব এই ক্রনিক স্ট্রেসের জন্যই হয়ে থাকে।

চলুন দেখা যাক ক্রনিক স্ট্রেস আমাদের শরীরের কি ক্ষতি করে এবং কিভাবে করে-

# স্ট্রেসের ক্ষতিকর প্রভাব :
_____________________

১)স্ট্রেস কোলেস্টেরল বাড়ায় :
—————— স্ট্রেসের ফলে আমাদের শরীরে স্ট্রেরয়েড ও এ্যাডরেনালিনের পরিমান বেড়ে যায়, যা শরীরের চর্বি ভেঙ্গে দেয় ফলে ফ্যাটি এসিড ও ট্রাইগ্লাইসেরাইড বেড়ে যায়, যা লিভারে গিয়ে VLDL এর পরিমাণ বাড়ায় ভিএলডিএল ব্লাডে এসে LDL এর লেভেল বাড়ায় ফলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল লেভেল বেড়ে যায়।

২) ব্লাড প্রেশার বাড়ে :
—————-স্ট্রেসের ফলে সিম্প্যাথেটিক এ্যাকটিভিটি বাড়ে যা হার্ট রেট ও পেরিফেরাল রেসিসট্যান্স বাড়ায় ফলে ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। এছাড়া স্টেরয়েড ব্লাড ভলিউম বাড়ায় যা ব্লাড প্রেশার বাড়াতে ভুমিকা রাখে।

৩) হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক :
——————- স্ট্রেসের ফলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল ও ব্লাড প্রেশার বাড়ে যা রক্ত নালীকে atherosclerosis করে। যার পরবর্তী ইভেন্ট হলো থ্রম্বোসিস (স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাক)

৪)পেট মোটা হয়ে যাওয়া :(এ্যাবডামিনাল ওবেসিটি) :
——————- স্ট্রেসের ফলে আমাদের শরীরে স্ট্রেরয়েড লেভেল বাড়ে যা হাত পা থেকে চর্বি কে ভেঙ্গে দেয় কিন্তু পেট মুখে চর্বির পরিমাণ বাড়ায়, এর কারণ হলো স্টেরয়েড পেটের 11-beta-HSD1 এনজাইমের এ্যাকটিভিটি বাড়ায় যা ফ্যাট লাইসিস এর থেকে ডিপোসিশনে বেশি কাজ করে।
অপরদিকে হাত ও পায়ের 11-beta-HSD 2 এর এ্যাকটিভিটি বাড়ায় যা ডিপোসিশনের থেকে লাইসিস বেশি করে।
ফলে দেখা যায় শরীরে স্ট্রেরয়েড বাড়লে হাত পা শুকিয়ে যায় কিন্ত পেট মোটা হতে থাকে।
(কোন ডাক্তার ক্লিনিকে ১ মাস কাজ করে আসলে এই ইফেক্ট দেখা যায়, মুখ ও পেটে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়)।

৫) বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা :
——————- স্ট্রেসে থাকলে মানুষ বেশি খায় কারণ তখন ক্ষুধা বেশি লাগে এর কারন হলো, স্টেরয়েড leptin এর রেসিস্ট্যান্স বাড়ায় ফলে leptin and neuropeptide Y এর ইমব্যালেন্স হয় এতে হাঙ্গার সেন্টার বেশি স্টিমুলেটেড হয়, ও স্যাটাইটি সেন্টার সাপরেসড হয়ে পরে ফলে বেশি বেশি ক্ষুধা লাগে। মানুষ বেশি খায় এই বেশি খাওয়া হলো মোটা হওয়ার আর একটা কারন।

৬) ডায়াবেটিস :
———— স্টেসের ফলে শরীরে স্টেরয়েড ও এ্যাডরেনলিন বাড়ে এরা লাইপোলাইসিস করে যাতে FFA and resistin লেভেল বেড়ে যায়, এই FFA, Resistin, স্ট্রেরয়েড ও এ্যাডরেনলিন insulin এর রেসিস্ট্যান্স বাড়ায় ফলে ইনসুলিন কাজ করতে পারে না এর ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়।

৭)মাথা ব্যাথা :
———– স্ট্রেসের ফলে মাথা ব্যাথা হয় বিশেষ করে মাইগ্রেন. এর কারণ হলো স্ট্রেসের সময় এ্যাডরেনালিন সেক্রেশন বেড়ে যায় যা নিউরোনের এ্যাডরেনালিন স্টোরেজ কমিয়ে দেয় ফলে সেকেন্ডারিলি এ্যাডরেনালিন কমে যায়, সাথে অন্য ভেসোডায়লেটর বেড়ে যায় যা ব্লাড ভেসেল ডায়লেট করে মাইগ্রেনের পেইন তৈরী করে (এটাকে বলে মাইগ্রেন -ভেসোডাইলেটর হাইপোথিসিস)।
এর ফলে মাইগ্রেনের পেইনে TCA দিলে পেইন ভালো হয়।

৮)এনক্সাইটি ও ডিপ্রেশন :
——————-
* স্ট্রেসে থাকলে শরীরে এ্যাডরেনালিন লেভেল বেড়ে যায় যা আমাদের চারপাশের প্রতি এ্যালার্টনেস বাড়ায়, ও সামনে আসা কিছুর প্রতি অতিরিক্ত চিন্তা(এনক্সাইটি) বাড়ায়।
* স্ট্রেসের ফলে অনেক বেশি এ্যাডরেনালিন নিউরোট্রান্সমিটার ইউজ হয়ে যায় ফলে সেকেন্ডারিলি এ্যাডরেনালিন লেভেল কমে যায় ফলে সহজেই ডিপ্রেশন তৈরী হয়।

৯)এ্যালজেইমারস (স্মৃতি ভ্রম) :
———————— স্ট্রেসে থাকলে আমাদের ব্রেইন অনেক বেশি কাজ করে, অতিরিক্ত কাজ করার ফলে নিউরোনের কার্যক্ষমতা কমে যায় সাথে কিছু প্রটিনকে ক্লাম্প করে নিউরোনে ডিপোজিট করে (টাউ প্রটিন)।
যার ফলে নিউরোন তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, ব্রেইনে ছোট হয়ে যায়, মেমরি লস হয় (অনস্টাবলিস্ট থিওরী)।

১০)দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া (accelerated aging)
——– মানুষ স্ট্রেসে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়, চুল পেকে যায়, চুল পরে যায়।
এর কারণ হলো
*স্ট্রেসে থাকলে শরীরে মেটাবলিজম বেড়ে যায় এর বাই প্রডাক্ট হিসেবে free radicals বেড়ে যায় যা সেলকে ড্যামেজ সেল বুড়ো করে দেয়।
* স্ট্রেসে heat shock protein বেড়ে যায় যা অক্সিডেটিভ স্টেসকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
* স্ট্রেস Telomere কে দ্রুত শর্ট করে দেয় ফলে সেল দ্রুত বুড়িয়ে যায়।

১১) GIT প্রবলেম :
————– স্ট্রেসে থাকলে HCl সিক্রেশন বাড়ে কারণ স্টেরয়েড প্রোস্টাগ্লান্ডিন ফর্মেশন কমিয়ে দেয় যা স্টোমাকের সাইটোপ্রটেকশন কমিয়ে PUD and GERD(হার্ট বার্ন) বাড়িয়ে দেয়।
দিন যত যাচ্ছে স্ট্রেস তত বাড়ছে, সাম্নে বাড়বে ছাড়া কমবে না, আর এই স্ট্রেসকে এ্যাভয়েড করার উপায় নাই। কিছু না কিছু স্ট্রেস সবাইকেই নিতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো যত কম নিয়ে পারা যায় এবং এই স্ট্রেস কে ম্যানেজ করার টেকনিক জানতে হবে। আর তা হলেই এই সব ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও বাচাঁ যাবে।

# স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট :
__________________
১) প্রেয়ার :
———প্রেয়ারের ফলে শরীরের সিমপ্যাথেটিক উইথড্রয়াল হয়, যা শরীরকে স্ট্রেস ফ্রী হতে সাহায্য করে।

২) মেডিটেশন :
———— মেডিটেশিনের মুল থীম ই হলো স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট. যা শরীর স্ট্রেস মুক্ত হতে সাহায্য করে।

৩)ডীপ ব্রেদিং (Deep breath) :
————————- Deep abdominal inspiration নিয়ে স্লোল expiration করলে প্যারাসিমপ্যাথেটিক এ্যাকটিভেশন হয় যা শরীরকে কুল করে।

৪) ক্যারোটিড ম্যাসাজ :
—————– ক্যারোটিড ম্যাসাজের প্যারাসিমপ্যাথেটিক এ্যাকটিভেশন হয় যা শরীরকে ঠান্ডা করে স্ট্রেস মুক্ত করে।

৫) অন্য রিলাক্সেশন টেকনিক ফলো করা :
——————————-
* কাজের ফাকে ফাকে অন্য কিছু করা, যেমন পেইন্টিং, প্লান্টিং, একুরিয়াম ফিস কাল্টিভেটিং.
* সাথে pets রাখা যেমন কুকুর. বিড়াল .খরগোস, টিকটিকি,সাপ 🙂
*কাজের জায়গা পরিস্কার পরিছন্ন রাখা.
* ওয়ার্কিং রুমের সুন্দর ডেকোরেশন করা বিশেষ করে দেয়ালে বিভিন্ন পেইন্টিং রাখা।

৬) খারাপ সিচুয়েশনকে হ্যান্ডেল ও ইগনোর করতে শিখা।

৭)নিজের কমিউনিকেশন দক্ষতা বাড়ানো।

৮) ব্যায়াম করা:
————— প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ মিনিট ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করলে স্ট্রেস কমে ,কারণ এক্সারসাইজের ফলে শরীরে Endorphine রিলিজ হয় যা মন কে প্রফুল্ল করে।

৯) গান গাওয়া এবং গান শোনা :
———–————– ২ ক্ষেত্রেই মেন্টাল রিলাক্সেশন হয়, স্ট্রেস কমে।

১০) হাসতে চেষ্টা করা :
——————–. পর্যাপ্ত পরিমাণে হাসি শরীরের স্ট্রেস হরমোন কমায়. মুখ কুঁচকে না রেখে জোর করে হাসির চেষ্টা করলেও স্ট্রেস কমে।

১১) গল্প করা ও আড্ডা দেয়া :
——————— গল্প করলে মেন্টাল ডাইভারশন হয় যাতে স্ট্রেস কমে
….
স্ট্রেস কমানোর জন্যে সর্বোপরি প্রয়োজন আপনার সদিচ্ছা। আপনি যখন স্ট্রেসে থাকবেন, তখন কথা বলুন আপনার পার্টনার অথবা বন্ধুর সাথে। শেয়ার করুন। একা একা মানসিক চাপ আরো বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে আপনার উপর।

লিখেছেন:
ডা. কাজী মুনির ইসলাম

drferdous:
Related Post