X

মহামারীতে সক্ষমতার বাইরেও সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা; তবুও লাঞ্ছিত – কেন?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩১ জুলাই, ২০২১, শনিবার

মহামারীতে সক্ষমতার বাইরে সেবা দিয়েও সমগ্র দেশজুড়ে চিকিৎসকরা হচ্ছেন রোগীর স্বজনদের দ্বারা নৃসংশ হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার। চলতি জুলাই মাসে ইতিমধ্যেই সমগ্র দেশে এ ধরনের প্রায় ৯টি ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া গিয়েছে।

২ জুলাই নিখোঁজ হওয়া এক ব্যক্তির লাশ ৩ জুলাই সকালে বাগেরহাটের শরনখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছালে কর্তব্যরত নারী চিকিৎসক ও তাঁর সহযোগী লাশের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অসামঞ্জস্যতা পান। ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য ইমার্জেন্সি রুমে আসলে লাশের সঙ্গে আসা সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীদের অভিযোগ ছিল- চিকিৎসক কেন লাশকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি? সেইসাথে লাশ বহন করে কেন ইমার্জেন্সি রুমে আনা হলো না?

৪ জুলাই- ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে কর্মরত চিকিৎসককে মারধর করে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা। মারধরের ঘটনাটির সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাসূত্রে জানা যায় জুয়েল রানা নামক কতিপয় যুবক বুকের ব্যাথা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে হাসপাতালে আসেন। জুয়েল রানাকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে তার স্ত্রী তানিয়াকে হাসপাতালের উপরের বেডে যেতে বলেন ডা.নাফিজ। চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মনঃপুত না হওয়ায় ডা.নাফিজ ও জুয়েল রানার স্ত্রী তানিয়ার মধ্যে তর্ক-বিতর্কের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আরিফুজ্জামান বিপাশ ও তার সহযোগীরা এসে জরুরী বিভাগের সামনে ডা. নাফিজকে মারধর করে।

৭ জুলাই- বাড়ি গিয়ে করোনা টেস্টের স্যাম্পল আনতে বলা হয়েছিল মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. সালেকীনকে। কিন্তু বিশেষ এ সেবা আপাতত বন্ধ থাকায় তাতে রাজী হতে পারেননি দ্বায়িত্বরত চিকিৎসক। আবদার পূরণ না হওয়ায় মুক্তাগাছা উপজেলা যুবলীগ সভাপতি মাহবুবুল আলম মনি বেধড়ক পিটিয়েছেন এই ডাক্তারকে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার হয়েছে মনি।

৯ জুলাই- দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা.আলমগীর হোসেন গিয়েছিলেন হাসপাতালে তার কক্ষের ওয়াশরুমে। এ সময় রোগীর ভাগিনা পরিচয়ে এক যুবক ইন্টার্ন চিকিৎসকের কক্ষে এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। ডা.আলমগীর ওয়াশরুম থেকে বের হলে কি হয়েছে তা জানতে চাইলে যুবকের সাথে কথা-কাটাকাটি হয়। রাতে ডা.আলমগির হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে খাবার খেতে গেলে রোগী ও তার স্বজনরা দেশী অস্ত্র-সস্ত্র সহ তার উপর হামলা করে। হামলাকারীরা তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মাটিতে ফেলে রাখে। খবর পেয়ে ডা.তাহমিদ আবীর ছুটে গেলে তাঁকেও বেধড়ক পিটানো হয়।

১৪ জুলাই -ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে বলায় চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে একদল দুর্বৃত্ত মারধর করে ডাক্তারসহ চিকিৎসাকর্মীদের। এ সময় তারা ভাঙচুর করে অপারেশন থিয়েটারও। এদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বিএসবিএ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন জসিম উদ্দিন ও মো. সোহেল নামের দুই ব্যক্তি। এ সময় হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আহত দুজনকে জরুরি বিভাগের মিনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় আহতদের স্বজনরাও জোর করে সেখানে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় চিকিৎসকরা হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে তাদের অপেক্ষা করতে বললে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।

একপর্যায়ে আহতদের একজন ক্ষিপ্ত হয়ে মোবাইলে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের খবর দিলে তাৎক্ষণিক মোটর সাইকেলযোগে ১৫-২০ জন লোক জোর করে হাসপাতালে ঢুকে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এ সময় তারা হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারী ও দারোয়ানকে নাজেহাল করে।

১৮ই জুলাই-এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে ভাঙচুর ও চিকিৎসকসহ নার্সের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম বাটিকামারী গ্রামের আলতাফ হোসেনের স্ত্রী জাহেদা বেগমকে (৫৫) অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। হাসপাতালের ল্যাব বন্ধ থাকায় বাইরে রোগীর রক্ত পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দেয় কর্তব্যরত চিকিৎসক। রক্ত পরীক্ষার পর বিকেলে হাসপাতালে আনার পরপরই জাহেদা বেগমের মৃত্যু হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সুজন পাল জানান, রোগীর অবস্থা আগে থেকেই সংকটাপন্ন ছিল। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা উত্তেজিত হয়ে জরুরী বিভাগে হামলা চালায়। এ সময় তারা কর্তব্যরত নারী চিকিৎসক, শিক্ষানবিশ নার্স এবং অন্যান্য কর্মীদের মারধর করে।

১৮ই জুলাই- বিকাল ৫ঃ৫৫ মিনিটে ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সের জরুরি বিভাগে জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী আসে। রোগীর Old MI,stroke ছিল। রোগীর লোকদের বুঝিয়ে বলা হয় যে রোগীর অবস্থা ভালো না এবং তাকে যত দ্রুত সম্ভব ময়মনসিংহ মেডিকেল এ নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। সাস্পেক্টেড কোভিড হওয়া সত্ত্বেও তাকে যথাযথ প্রাথমিক চিকিৎসা,অক্সিজেন দেয়ার কিছুক্ষণ পরে রোগীর লোকজন ময়মনসিংহ মেডিকেলে না নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তারা আবার ৭ঃ১৪ মিনিটের দিকে রোগীকে নিয়ে আসে মৃত অবস্থায়। এ সময় ইসিজি করার আগ মূহুর্তে রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে জেনে সাথে থাকা দুই জন ইমারজেন্সির চেয়ার তুলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা.সাদিয়াকে মারার জন্য দৌড়ে আসে। ডা. সাদিয়া কোনোক্রমে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হওয়াতে ভয়াবহ ইনজুরির হাত থেকে বেঁচে যায়।

২৫শে জুলাই- ২৫ জুলাই রবিবার কুমিল্লা এএফসি ফরটিস হাসপাতালে কোভিডে আক্রান্ত রােগী করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রেফার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লাঞ্ছনার শিকার হন উক্ত হাসপাতালের এক কর্তব্যরত চিকিৎসক।
উক্ত ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেখা যায় রােগীর স্বজনরা কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মাে. তানভির আকবরের উপর নির্মমভাবে হামলা চালান, তাকে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করেন, হাসপাতাল ভাঙচুর করেন ও সবশেষে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পালিয়ে যান।

২৭ জুলাই – অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগে নোয়াখালীর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। চিকিৎসকরা জানান, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রোগীর স্বজনরা আইসিইউ ইউনিটে ভাঙচুর করেন। এ সময় হাসপাতালে অবস্থিত চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়।

মহামারীতে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সেবাদানকারী চিকিৎসকদের উপর বারংবার এসব হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের আপামর চিকিৎসক সমাজ।

ওয়াসিফ হোসেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্ল্যাটফর্ম

হৃদিতা রোশনী:
Related Post