X

মতলব আইসিডিডিআরবি কেন্দ্রঃ স্বাস্থ্য গবেষণার এক পীঠস্থান

মেঘনা নদীর তীরের অববাহিকায় অবস্থিত একটি জেলা চাঁদপুর। সেই জেলার একটি স্থানের নাম মতলব। প্রকৃতপক্ষে মতলব প্রশাসনিক দিক দিয়ে দুটো উপজেলায় বিভক্ত। মতলব উত্তর এবং মতলব দক্ষিণ। এই মতলবেই ১৯৬৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উন্নয়নশীল দেশে অন্যতম বৃহৎ এবং দীর্ঘ স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প বা Health and Demographic Surveillance System (HDSS) চালিয়ে যাচ্ছে।

http://caiteberly.blogspot.com/ থেকে নেওয়া

মতলবের এই গবেষণাকেন্দ্রের নাম মতলব স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র বা Matlab Health Research Centre (MHRC)। এর প্রধানত দুটো অংশ।

১। ক্লিনিক্যাল গবেষণা শাখাঃ যা ক্লিনিক্যাল সেবা প্রদান এবং গবেষণা করে থাকে।

২। কমিউনিটি স্বাস্থ্য গবেষণা শাখাঃ পরিবার পরিকল্পনা এবং শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে সেবা প্রদান করে থাকে। এই শাখাও অনেক গবেষণা করে থাকে।

কিন্তু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইলে মতলব গবেষণাকেন্দ্র তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে গবেষণা এবং সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

১। স্বাস্থ্য এবং জনমিতিক সারভেইল্যান্সঃ
এই জনমিতিক সারভেইল্যান্স  শুরু হয়েছিল ২৮০০০ মানুষের উপর ভিত্তি করে। এখন এর অধীনে রয়েছে ২২৫০০০ মানুষ। এখন ছকবদ্ধ প্রশ্নাবলীর মাধ্যমে ১৪২ টি গ্রামের প্রতিটি বাসা থেকে ২ মাস অন্তর অন্তর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, ডিভোর্স, মাইগ্রেশন, অভ্যন্তরীণ বাসস্থান পরিবর্তন কিংবা যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা হয়।

এখান থেকেও পেশাগত এবং সামাজিক তথ্য নেওয়া হয়। অনেক গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায় নাই, বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে কিংবা পয়নিস্কাশন ব্যবস্থাও ভালো না। প্রতিটি বাড়িকে ধনী থেকে গরীব ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন ধনীদের টিনের ছাদ রয়েছে আর গরীবরা সাধারণত বাঁশ বা অন্যান্য জিনিস দিয়ে তৈরি। বেশির ভাগ বাসায় মাটির মেঝে আছে এবং লাকড়ির চুলায় রান্না করে।

১৪২ টি গ্রামকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ঃ
১। যারা সরকারী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন, তাদের বেস লাইন ধরা হয়।
২। যারা আইসিডিডিআরবির স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন এবং নানা গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন।
মতলবের ১৯৬৩ সাল থেকে চলে আসা সারভেইল্যান্স সিস্টেম জনমিতির নানা পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এবং নানা স্বাস্থ্য গবেষণার প্রয়োগের ফলাফল লিপিবদ্ধ করে।

এই মতলবের গবেষণার ফলাফল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কলেরা ভ্যাক্সিন ব্যবহার বন্ধ করতে এবং গর্ভবতী মহিলাদের ধনুষ্টংকারের টিকাদানের নীতিমালা প্রণয়নে সহায়তা করেছে।

২। কমিউনিটি স্বাস্থ্য গবেষণাঃ
স্বাস্থ্য, জনমিতি এবং পুষ্টির উপর চলে এই গবেষণা। ৪১ টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৪ টি আঞ্চলিক ক্লিনিকে ৬০ হাজার রোগীর উপর এই গবেষণা চলে। সুপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ক্লিনিকে সেবা দেন। তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রজননশিক্ষা, শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং তাদের মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকেন। এই স্বাস্থ্য কর্মীদের টিকাদান কর্মসূচীর সাফল্যের হার ৯৫% এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির হার ৭৫%।

৩। মতলব হাসপাতালঃ
দক্ষিণ  মতলব উপজেলায় অবস্থিত এই মতলব হাসপাতাল প্রতি বছর ৩০০০০ এর বেশি মানুষকে ডায়রিয়া, মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্যের উপর সেবা দিয়ে থাকে।  আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সরা পালাক্রমে এই মতলব হাসপাতালে ডিউটি করেন। এর ফলে ঢাকার সাথে এর স্বাস্থ্যসেবার মানের সমতা বজায় থাকে।

মতলব সেন্টারের গর্ব তাদের মূল হাসপাতাল। একে বলা হয় আইসিডিডিআরবি মতলব হাসপাতাল। এখানে ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগব্যাধি, অপুষ্টি এবং মাতৃরোগের নানা চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।

মতলবের অর্জনঃ

মতলবে গত তিন দশকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত জ্ঞান এবং তথ্য সরকার এবং আইসিডিডিআরবির নীতিমালা বা গাইডলাইন প্রণয়ন, পরিবর্তন এবং পরিমার্জনে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। মতলবের গবেষণা কেন্দ্রে  একদল দক্ষ এবং সুপ্রশিক্ষিত গবেষক দল। রয়েছে নিবেদিতপ্রাণ একদল মাঠ কর্মী। এই মতলব সেন্টারের অধীনে চারটি সাবসেন্টার রয়েছে যেখানে একদল প্যারামেডিক ২৮ হাজার মানুষকে সেবা দিয়ে থাকেন।

১। বাংলাদেশে রোগতত্ত্বের যে পরিবর্তন ঘটছে অর্থাৎ সংক্রামক ব্যাধি থেকে অসংক্রামক ব্যাধির হার বেড়ে গিয়েছে তা জানা যায় মতলব থেকে। ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান গবেষকরা। এই জন্য ব্যবহার করা হয় মতলবের তথ্য। গবেষক কারার জুনায়েদ  আহসান এবং নুরুল আলম এই দলের প্রধান সদস্য ছিলেন।

২। অপুষ্ট এবং অপরিণত নবজাতক, যারা ৩৭ সপ্তাহের কম সময়ে জন্মগ্রহণ করে এবং যাদের ওজন দুই কেজির কম তাদের চিকিৎসার জন্য ব্যতিক্রমধর্মী, বাস্তবসম্মত এক চিকিৎসাপদ্ধতি চালু হয়েছে আইসিডিডিআরবি মতলব হাসপাতালে। এ চিকিৎসাপদ্ধতির নাম ক্যাঙারু  মাদার কেয়ার (ক্যাঙারু  মাতৃসেবা)। এ চিকিৎসাপদ্ধতি ইনকিউবেটর পদ্ধতির মতোই কার্যকর। এতে গরিব-দুস্থ মায়েদের অপুষ্ট নবজাতকরা, বিনা খরচে চিকিৎসা পাচ্ছেন।

২০০৭ সালে এ চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হয়। গত প্রায় ৭ বছরে এ পদ্ধতির মাধ্যমে ৬৭টি গ্রামের ৮০০ জনের বেশি অপরিণত শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়।

হাসপাতালের ক্যাঙারু মাতৃসেবা বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা জানান, ক্যাঙারু যেভাবে শরীরের উষ্ণতা দিয়ে পেটের থলিতে থাকা বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখে এ পদ্ধতির চিকিৎসাও সেরকম।
স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের নবজাতকের শরীরে তাপমাত্রা হ্রাসের ঝুঁকি থাকে। এতে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে মায়ের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নবজাতকের শরীরে প্রবাহিত হয়। শিশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং শিশুর মৃত্যুঝুঁকি কমে। এ পদ্ধতিতে মায়ের বুকের দুধপান নিশ্চিত হয় এবং সন্তানের সঙ্গে মায়ের বন্ধন দৃঢ় হয়।

আইসিডিডিআরবি মতলব হাসাপাতালের প্রধান ডা. মো. আল ফজল খান বলেন, এটি কার্যকর পদ্ধতি। এতে দুসপ্তাহ থেকে এক মাসের মধ্যে অপরিণত সদ্যজাত শিশু মৃত্যুঝুকি থেকে রক্ষা পেয়ে সুস্থ হয়।

৩। ১৯৭৫ সালে মতলবে আইসিডিডিআরবি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রি বিতরণ প্রকল্প হাতে নেয়। এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার বেড়ে গেলেও এই চর্চা ধরে রাখা যায় নাই। কিন্তু মতলবের এই প্রকল্পের ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা জানা যায়। এটাও বোঝা যায়, মানুষের স্বভাব এবং বিশ্বাসের সাথেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

১৯৭৭ সালে মতলবে আরেকটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরিবার পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প নামে এই প্রকল্পে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে  শিক্ষিত এবং সদ্য বিবাহিত তরুণীদের নেওয়া হয়। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্ন গ্রামে বিবাহিত মহিলাদের সাথে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। মা এবং শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কেও এই স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এর ফলে জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীদের তারা  হাসপাতালে রেফার করতে পারতেন। ধীরে ধীরে হাম এবং ধনুষ্টংকারের বিরুদ্ধে টিকাদান এই প্রকল্পের অধীনে যুক্ত হয়।

এই প্রকল্পের ফলে ১৯৭৮ সালের শেষে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার ১০% থেকে ৩৪% এ উন্নীত হয়। ১৯৮৫ সালে এই হার ৪৫% এ উন্নীত হয়। এর  আশে পাশের এলাকায় যেখানে আইসিডিডিআরবির কার্যক্রম নাই (একে কন্ট্রোল এলাকা বলে) ১৯৮৪ সালের জরিপে দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহারের হার মাত্র ১৬%। ১৯৯০ সালে এই পার্থক্য হয়ে দাঁড়ায় ৫৭% বনাম ২৭%।

১৯৯৬ সালে মতলবে পরিচালিত জরিপে জানা যায় ২০ বছর আগের প্রকল্পের ফলাফল। দেখা যায় দীর্ঘ মেয়াদি সুবিধা লাভ করেছে পরিবারগুলো যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে পরিবারের আকা ছোট হয়েছে ফলে স্বাস্থ্য এবং অর্থ উভয় দিকেই পরিবারগুলো লাভবান হয়েছে। এখানে টিকাদান কর্মসূচির সফলতার ফলে আশেপাশে কন্ট্রোল এলাকার থেকে ৫ বছরের নিচের শিশুর মৃত্যুহার ৩০% কমে গিয়েছে।
৪। মতলবের গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যই আমাদের কে জানায় ৬৩% শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব টিকাদানের মাধ্যমে। পরিবার পরিকল্পনা,  মা এবং শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষে পরিচালিত প্রোগ্রামের ফলে মতলবের শিশুমৃত্যুর হার গত ২৫ বছরে ৭৫% হ্রাস পেয়েছে।

৫। এখানে গত ৪০ বছরে গড় আয়ু ৫০ থেকে ৬৫ বছরে উন্নীত হয়েছে।

৬। এই অঞ্চলেই প্রথম ওরস্যালাইনের ট্রায়াল দেওয়া হয়। প্রথম দিকের কলেরা ভ্যাক্সিনের পরীক্ষাও এই মতলবে করা হয়।

৭। এই অঞ্চলে মা এবং শিশুর সাস্থ্যের সেবার জন্য এখানে শিশুর বয়স ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বুকের বুধ খাওয়ানোর হার ৭৫% এবং স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে প্রসবের হার ৮০% এ উন্নীত হয়েছে।

৮। বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে আপনারা সবাই অবগত রয়েছেন। বাংলাদেশে, সর্বপ্রথম ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বড়ঘরিয়া ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়। এরপর ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের ৬১টি জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জানায়: ৪২% নলকূপের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে বেশি (২৫% নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মানের চেয়ে বেশি) মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। দিনে দিনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে চলেছে।

২০০১ সালে মতলবের জনগোষ্ঠীর ওপর আর্সেনিকের প্রভাব দেখার জন্য আইসিডিডিআরবি আস-ম্যাট (As-Mat) নামক প্রকল্প হাতে নেয়। যা আর্সেনিকের মৃত্যুহার এবং সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে অন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে।

তথ্যসূত্র এবং কৃতজ্ঞতাঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Matlab_(Bangladesh)
২। http://www.icddrb.org/how-we-do-it/our-field-sites/matlab
৩। শিশুর সুরক্ষায় ‘ক্যাঙারু মাতৃসেবা’, দৈনিক আমাদের সময়, ১৫ মে, ২০১৪।
৪। Karar ZA, Alam N, Streatfield PK: Epidemiological transition in rural Bangladesh, 1986-2006. Global Health Action 2009, 2.
৫। http://www.icddrb.org/media-centre/feature/fertile-ground-for-family-planning
৬। http://www.icddrb.org/who-we-are/our-people/3917-chapter-6-migration
৭। http://www.icddrb.org/who-we-are/our-mission/4005-tables-of-rates
৮। http://www.icddrb.org/component/content/article/10030-news/2197-researchers-investigate-levels-of-arsenic-and-cadmium-in-food-chain-in-bangladesh
৯। http://www.icddrb.org/how-we-do-it/our-hospitals/matlab-hospital
১০। http://www.icddrb.org/images/stories/HowWeDo/matlab%20factsheet.pdf
১১। http://www.icddrb.org/media-centre/feature/matlabs-kangaroo-mother-care-saving-lives

লেখকঃ ডা রজত দাশগুপ্ত

rajat:
Related Post