X

“ভয়াবহ বাণিজ্য” – করছেন কারা? ডাক্তার না মিডিয়া?

কিছুদিন আগেই গত ২৪ জানুয়ারি দেশের বহুল প্রচারিত ৫ টাকা মূল্যের একটি দৈনিকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি খবর ছিলো “চিকিৎসা নিয়ে ভয়াবহ বাণিজ্য”। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের টেবিল এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। অনেকেই একদিকে যেমন ধন্য ধন্য করেছেন ঐ সংবাদ প্রতিনিধিকে। অন্যদিকে দেশীয় চিকিৎসকদের গুষ্টি উদ্ধারে গভীর উলঙ্গ মনোনিবেশ করেছেন অনেকেই।

 

এ সংবাদ পরিবেশনের ৪ দিন পর গত ২৮ জানুয়ারী ঐ একই পত্রিকার অন্য একটি বিজ্ঞাপন দৃষ্টি কাড়ে অনেকেরই। বিজ্ঞাপনটি ছিলো ভারতীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতাল এবং তার একজন চিকিৎসক নিয়ে। না, এটা নিয়ে অবশ্য কোন সমালোচনা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া পড়েনি হাহাকার কিংবা দেশপ্রেমের বাণীর হুঙ্কার।

 

কিন্তু পত্রিকার এই আচরণ নিয়ে মূলতঃ দ্বিধায় পড়েছি আমরা। অর্থাৎ যারা বাংলাদেশের চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করছি। এই মুহুর্তে ‘সেবা’ এবং ‘বাণিজ্য’ এই শব্দের দারুন দ্বন্দে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

 

চিকিৎসকেরা সেবার পেশায় আছেন। একদিকে যেমন তারা সেবক। অন্যদিকে তারা পেশাজীবী। অর্থাৎ সেবা প্রদানের পাশাপাশি এই পেশা দ্বারা অর্জিত অর্থই আমাদের জীবিকা।

 

এই চিকিৎসকেরা পরামর্শ ফী নিলে সেটা বাণিজ্য।

আর বোধ করি বিদেশী ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা হাসপাতালের প্রচারণায় গলা মিলিয়ে, দেশের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বিদেশী চিকিৎসাব্যবস্থাকে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে প্রমোট করাটা নিশ্চয়ই “জনসেবা”

বিশেষতঃ পত্রিকাটির ট্যাগ লাইন যেহেতু “আমরা জনগণের পক্ষে”

স্বভাবতই যে প্রশ্নটি আসে… “… কিন্তু কোন দেশের?”

এটা কি জাতির সাথে দেশের সাথে প্রতারণা করা নয়??

এসব প্রশ্ন আমরা করি না, করবো না। কারন প্রশ্ন করাটা আমাদের কাজ না।

প্রথমোক্ত রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে … “সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা নিয়ম-নীতি মানেন না। বেসরকারি হাসপাতালে চলছে শুধুই বাণিজ্য। চিকিৎসাসেবা বলে কোথাও কিছু নেই। যার যা খুশি তাই করছে। পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা”

সরকারী দপ্তর এ অব্যবস্থাপনার সকল দায় চাপানো হলো চিকিৎসকদের ওপর। ‘চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে কোথাও কিছু নেই…’ এ ধরনের কথা বলার আগে অসংখ্যবার ভাবার প্রয়োজন ছিলো রিপোর্টার মহোদয়ের। তিনি রিপোর্টিং করছেন। গালগল্প লিখছেন না। তার এই লেখা হাজার হাজার কপি ছাপা হবে। হাজার হাজার মানুষ তা পড়বে, বিশ্বাস করবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গালি দেবে এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশের পথে পা বাড়াবে। কার স্বার্থ রক্ষায় এই রিপোর্ট? জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট এ ৪৫০ শয্যার বিপরীতে ১৫০০ এর বেশী মানুষের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। কারা দিচ্ছে? চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে কোথাও যদি কিছু না থাকে, ৩ গুণ মানুষের সেবা দিয়ে অযথা অমানসিক পরিশ্রম কেন করছেন আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা? এই একই গল্প বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারী মেডিকেল কলেজের এবং পিজি হাসপাতালের। এগুলো নিশ্চয়ই সেবা না, পুরোটাই’বাণিজ্য’ !!

 

দ্বিতীয় রিপোর্টটি ছিলো মূলতঃ হাসি উদ্রেককারী।  যাক অন্তঃত দেশের মানুষের চিকিৎসা নিয়ে আমরা ভাবি, না ভাবি, কেউ না কেউ তো ভাবছে!! তাই আপনাদের এই আয়োজনের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী। আমাদের দেশের অনেক মা-বোন ইনফার্টিলিটির সমস্যা নিয়ে ভুগেছেন বা ভুগছেন। শুধু আরেকটি সত্য আরা দেখি না বা ভুলে যাই, এদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, এদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমাদের আরো অনেক মা-বোন গাইনেকোলজির দুষ্কর প্রান্তর চষে বেড়াচ্ছেন। পরিবারকে সময় না দিয়ে, সামাজিক রীতিনীতির পেষণ সহ্য করে, ‘ঘরের কাছে পর’ হয়ে এক একজন নারী চিকিৎসক ‘বিশেষজ্ঞ’ হন আমাদের দেশে।

 

আজকের এই বিজ্ঞাপন তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি নিদারুণ চপটাঘাত। অবশ্য আপনারা যেহেতু ‘জনগণের পক্ষে’, যেহেতু এতে জনগণের নিশ্চয়ই ভালোই হবে। মোহাচ্ছন্ন এক দল তরুণ নারী চিকিৎসকের ভুল ভাঙ্গবে যে দেশের তাদের অবদানের আদৌ কোন মূল্য নেই। আর স্বপ্ন ভঙ্গ হবে আমার দেশের হাজারো মা-বোনের। হোক না। কী এসে যায়। ভারতের হেলথ ট্যুরিজম তো আছেই। আরো অনুপ্রেরণা দেওয়া হোক ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে, দেশীয় মিডিয়া দিয়ে।

 

বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা আকাশ থেকে টপকে পড়েননি। তারাও এদেশের সন্তান। ভীড়ের মাঝে পকেট মার থাকে ২/১ জনই। তাই বলে সকল পথচারীকে পকেটমার ভাবা যেমন ঠিক না। ঠিক তেমনি অন্যান্য সব পেশার মতো চিকিৎসকদের মাঝেও কতিপয় দুষ্কৃতিকারী থাকতেই পারে। তাই বলে গোটা চিকিৎসক সমাজের আত্মত্যাগকে ভুলুন্ঠিত করে বিষেদগার করার অধিকার কোন সংবাদ মাধ্যম এর আছে কী?

 

বিজ্ঞাপন দেবারও বোধ করি একটি নীতিমালা আছে। যতোদূর জানি, ঔষধ জাতীয় পণ্য, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদির বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা তার অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন/ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। ভারতীয় এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের আগে সেই অনুমোদন নেওয়া হয়েছিলো কি?

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটা প্রতিবাদলিপি দেওয়া হয়েছিলো সেই পত্রিকার “চিকিৎসা নিয়ে ভয়াবহ বাণিজ্য” শিরোণামে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদে। পয়সা দিলে সেটাও হয়তো ছাপা হতো। হয় নি।

শুভকামনা রইলো। কাটতি বাড়ুক বাংলাদেশের এই সব পত্রিকার। যেহেতু এটা বাণিজ্য না, জনসেবা।

জনগণ শুধু একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ‘জনগণের পক্ষে’র মানুষগুলোকে চিনে নিক।

আর এদেশের চিকিৎসকদের করার ‘কিছু’ই নেই। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই। চাইলে হাসপাতালেও মারতে পারেন ডাক্তারকে। ক্যাম্পাসের বাইরে তো চাইলে মেরেই ফেলতে পারেন। বিচার আমরা পাইও না, আজকার আর চাইও না। পত্রিকায় কিংবা ফেসবুকে আদর করে ‘কসাই’ বা ‘কমিশনখোর’ নামে ডাকতে পারেন। বিনা বেতনে অনারারি করে যারা তিলে তিলে গড়ে তোলেন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, লিখে দিন নির্ভয়ে, তারা করছে “বাণিজ্য”।

‘আমরা জনগণের পক্ষে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে যারা ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আমাদের সামনেই প্রমোট করে যাচ্ছে, তাদের জন্য নিরন্তর শুভেচ্ছা। এভাবেই হয়তো অনেক দূর এগিয়ে যাবে আমার হতভাগা বাংলাদেশ।

ডাঃ রাজীব দে সরকার

বিশেষ কর্মকর্তা, কো-অর্ডিনেশন সেল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ

ব্যাচঃ এফ-১৫

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

View Comments (2)

Related Post