X

ভ্যাকসিন-টিকা ও ধর্মীয় বিরোধ

 

শিরোনামে অবাক হবার কিছু নেই। জেনে অবাক হবেন আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেন কোন না কোন সময় আপনার সেই একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী কেউ না কেউ ধর্মীয় কারন দেখিয়েই ভ্যাকসিনেশন এর বিরোধিতা করেছে। হোক সে খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদী বা হিন্দু!

 

ইদানিং বিভিন্ন ফোরামে লক্ষ্য করা যায় এক শ্রেনীর মানুষ টিকার বিরোধীতা করছেন এবং নিজের সন্তান বা বংশধরদের টিকা গ্রহন থেকে বিরত রাখার মত ভয়ংকর কাজ করছেন কিছু ধর্মীয় ভুল ধারনা কিংবা অপব্যাখ্যার কারণে। কি কি কারণে তারা বিরত থাকছেন তার কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যেমন:

 

 

১) এগুলো ইহুদী বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র

– আসলে তা নয়, বহু মুসলিম বিজ্ঞানীই বিভিন্ন সময়ে দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে ভ্যাকসিন তৈরিতে অবদান রেখেছেন। আর ভ্যাকসিন ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকল দেশেই ব্যবহার করা হয়। এটি শিশুদের জন্মগত অধিকার, সুস্থ থাকার জন্য।

 

২) ভাকসিন শুধুমাত্র গরীব আর মুসলিম দেশেই দেয়া হয় তাও বিনাপয়সায়, ধনী দেশেরা নেয়না
– কথাটি মোটেও সত্য নয়। সারা পৃথিবী শিশুদের মৃত্যুহার কমানোর ব্যাপারে সচেতন তাই বরং উন্নত দেশে ভ্যাকসিন গ্রহনের হার আরো বেশি। পৃথিবীর সকল শিশু যেন সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেচে থাকতে পারে তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দরিদ্র দেশে ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে দেয়া হয়। এটি আপনার শিশুর অধিকার।

 

 

৩) রোগ সৃষ্টি ও সুস্থ করার মালিক আল্লাহ তাই রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ করার চেস্টা অনৈসলামিক

– বরং উল্টো, বেশ কিছু সহীহ হাদিস অনুসারে নবী (স:) বলেছেন রোগ প্রতিরোধ এর কথা, তা হবার আগেই। ইসলামিক ফতোয়া প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার আলেমগণ তাই ভ্যাকসিন গ্রহনের পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং পৃথিবীর কোন মুসলিম দেশেই টিকা নিষিদ্ধ নয় কেননা ভ্যাকসিন গ্রহনের কারনে যদি কেউ সুস্থ থাকে তবে তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে কেননা তিনিই এটিকে কবুল করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যখ্যা এই লিংকগুলোতে পাবেন:
http://www.islamweb.net/…/…/taking-vaccines-against-diseases
https://islamqa.info/en/159845
https://islamqa.info/en/20276

 

৪) ভ্যাকসিন নিলে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে কারন এতে ক্ষতিকর উপাদান থাকে

– এটি একটি ভুল ধারনা। ভ্যাকসিন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে বা বাড়ায়। এ প্রক্রিয়ায় জৈবনিক বিক্রিয়ার অংশ হিসেবেই অনেক সময় কোন কোন শিশু (সবাই নয়) কিছুটা অসুস্থ বোধ করতে পারে যেমন জ্বর হওয়া। এটি একটি সাধারন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা দ্রুতই চলে যায়। তবে অনেক সময় অন্যান্য আরো কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে এমনকি মারা গিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে যেগুলোর কারন খতিয়ে দেখা গেছে ভ্যাকসিন এর সাথে অসম্পর্কিত। সুতরাং ভ্যাকসিন নেবার পর শিশু অসুস্থ বোধ করলে ভয়ের কিছু নেই, শিশুকে নিকটস্থ চিকিতসকের কাছে নিয়ে পরামর্শ গ্রহন করুন। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত:
http://www.who.int/…/immunization_misconcept…/en/index3.html

 

 

৫) ভ্যাকসিনে মূল জীবানুই শরীরে ঢোকানো হয় যা ক্ষতিকর এবং উল্টো রোগ তৈরি করে।

– ভুল ধারনা। এটি সত্য যে ভ্যাকসিনে মূল জীবানুকেই বা তার অংশ বিশেষকে ব্যবহার করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত জীবানু বা তার অংশ বিশেষ ব্যবহার করা হয় যার রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা নেই কিন্তু প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষমতা আছে। অনেকটা এমন যে বাচ্চাদের চোর বা ডাকাতের ছবি দেখিয়ে বলা তারা দেখতে এরকম, এদের থেকে দূরে থাকো। তাই পরে আসল চোর ডাকাত (রোগ) এলে আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকায় ক্ষতি হয়না। কিছু ক্ষেত্রে জীবিত জীবানূ ব্যবহার করা হয় তবে সেসব ক্ষেত্রে জীবানুগুলো ইনএকটিভেটেড অর্থাৎ রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম করে ফেলা হয় জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। তাই ভ্যাকসিনে কোন দূষিত বা ভয়ংকর কিছু নেই যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।

 

৬) ভ্যাকসিনের কারনে শরীরে ক্যান্সারের মত রোগ সৃষ্টি হতে পারে
– একেবারেই বিপরীত ধারনা বরং অনেক ক্যান্সারেই প্রতিরোধ করে ভ্যাকসিন যেমন হেপাটাইটিস এর ভ্যাকসিন লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, জরায়ূমুখ ক্যান্সার ভ্যাকসিন জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এসব ভ্রান্ত ধারনা সাধারনত অস্বীকৃত কোয়াক ডাক্তার বা হোমিও আয়ুর্বেদ প্র‍্যাকটিশনার যাদের স্বীকৃত যোগ্যতা নেই এমন লোকেরাই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রচারনা করেন।

 

 

৭) ভ্যাকসিন ক্ষতিকর, এ কারনে হোমিওপ্যাথিতে কোন ভ্যাকসিন নেই।

– আসলে হোমিওপ্যাথিতেও ভ্যাকসিন আছে।  তবে পৃথিবীর বহু দেশেই এটিকে বন্ধ করা হয়েছে এমনকি খোদ ইউরোপেই। কেন হোমিওভ্যাক্সিন নেবেন না তার ব্যাখ্যা এখানে আছে পড়ে নিতে পারেন:http://m.huffingtonpost.ca/…/homeopathic-vaccines-_b_248413…

 

নাগরিকের সুস্থতা নিশ্চিত করা রাস্ট্রের দ্বায়িত্ব, সন্তানকে সুস্থ রাখাও বাবা মায়ের দ্বায়িত্ব। তাই আপনি যদি ভ্রান্ত ধারনায় পড়ে আপনার বাচ্চাকে টিকা না দিয়ে ঝুঁকিতে রাখেন তাহলে আপনি তার অধিকার নষ্ট করলেন, বাবা-মা হিসেবে আপনার দ্বায়িত্বের অবহেলা করলেন এবং রাস্ট্রকেও ব্যর্থ করলেন এমনকি ইসলাম কিংবা আপনার ধর্মের দৃষ্টিতেও রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার চেস্টার বিরোধিতাও করলেন। সুতরাং এসব ভ্রান্ত ধারনা থেকে বেরিয়ে আসুন। মনে কোন প্রশ্ন থাকলে নিকটস্থ চিকিৎসক, ইসলামিক বিশেষজ্ঞের নিকট জিজ্ঞেস করুন, কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞানভান্ডার থেকে তথ্য নিন।

একসময় গুটি বসন্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছে, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে, প্লেগ রোগে মহামারীতে মরেছে, আগে ৮-১০টি বাচ্চা হতো তার মাঝে ২-১ মারা যেত অধিকাংশ পরিবারেই এখন এসব কিছুই নেই। পৃথিবীতে গুটি বসন্ত আজ বিলুপ্ত, প্লেগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে, বাংলাদেশ আজ পোলিওমুক্ত এই সবই ভ্যাকসিনের কল্যানে। তাই আধুনিক চিকিতসা বিজ্ঞানের আশির্বাদ গ্রহন করুন, নিজে সুস্থ থাকুন আপনার পরিবারকেও সুস্থ রাখুন।

 

 

সম্পাদনায় ঃ ডাঃ মারুফুর রহমান অপু,Medical Officer at Center for Medical Biotechnology, DGHS

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation
Related Post