X

বড় হতে না চাওয়ার আরেক নাম পিটার প্যান সিনড্রোম

২৭ অক্টোবর, ২০১৯

পিটার প্যান সিনড্রোম কি?
পিটার প্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি হলো তারা, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও জাগতিক সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে, সমাজ সংসারের অংশ হওয়ার পরিবর্তে সেখান থেকে মুক্তির পথ খোঁজে।

এই শব্দটি কাল্পনিক শিশু চরিত্র পিটার প্যান থেকে এসেছে, যার বয়স কখনোই বাড়ে না।
এই ধারণাটি প্রথম তুলে ধরেন ডাঃ ড্যান কেলি (মনোবিশ্লেষক) তাঁর “The Peter Pan Syndrome: Men Who Have Never Grown Up” নামক বইয়ের
মাধ্যমে যা 1983 সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

পিটার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনোই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা বড় হতে বা সাবালকত্ব লাভ করতে চায় না। তারা অনেকটা বইয়ের পাতার পিটার প্যানের মতোই ভাবে:
“স্বপ্ন সত্যি হয়, শুধু যদি আমরা তীব্রভাবে তাদের কামনা করি।”

কিন্তু তারা বুঝতে চায় না, স্বপ্ন সবার ক্ষেত্রে সত্যি হয় না। স্বপ্ন সত্যি হয় শুধু তাদের, যারা কেবল স্বপ্ন দেখাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রমও করে।
আর এই না বোঝার ফল হয় মারাত্মক। একটি সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে তারা নিজ হাতে নষ্ট করে। ক্যারিয়ারে যেমন তারা কখনোই নিজেদের যোগ্যতার সমতুল্য অবস্থানে পৌঁছাতে পারে না, তেমনই তারা ব্যর্থ হয় ব্যক্তিজীবনে কোনো অর্থবহ ও টেকসই সম্পর্ক গড়ে তুলতেও।

কারা বেশি আক্রান্ত হয়?

ইউনিভার্সিটি অব গ্রানাডা হতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পিটার প্যান সিনড্রোমে নারী-পুরুষ উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে, তবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। পুরুষদের অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝাই
এর পেছনে প্রধান কারণ।
আবার নারীদের পিটার প্যান সিনড্রোমে কম ভোগার পেছনে বড় কারণ হতে পারে নারীদের মানসিক পরিপক্বতাও।

লক্ষণ ও উপসর্গ

পিটার প্যান সিনড্রোমের সকল লক্ষণ ও উপসর্গই দুইটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত:
১.স্বাভাবিক কর্মজীবন পরিচালনা ও সম্পর্ক রক্ষায় ব্যর্থতা
২.যেকোনো দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার মানসিকত

রোগের উপসর্গ

১. স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনে ব্যর্থতা

মানসিক পরিপক্বতার অভাবে পিটার প্যানরা অল্পতেই ধৈর্য হারায়, হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, পরিশেষে কাজের সুযোগ হারায়। এভাবে বারবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণে তাদের পক্ষে একটি স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনও সম্ভব হয় না।

২. অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থতা

স্থায়ী ক্যারিয়ার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার ফলে পিটার প্যানদের সবসময় টাকা-পয়সার টানাটানিও লেগেই থাকে। অর্থনৈতিকভাবেও তারা খুব কম সময়ই স্থিতিশীল হয়ে থাকে। আবার অর্থনৈতিক দায়িত্বশীলতার প্রয়োজনীয়তাটাও তারা ঠিক উপলব্ধি করতে পারে না।

৩. এক কাজে বেশিদিন মন বসাতে ব্যর্থতা

পিটার প্যানরা শুধু কর্মক্ষেত্রেই না বরং যেকোনো শখ বা পছন্দসই কাজেও তারা খুব বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। আজ হয়তো তাদের নতুন কোনো একটি কাজ ভালো লেগে গেল। তাই পরের কয়েকদিন খুব উৎসাহের সাথে তারা কাজটি করল। কিন্তু এরপরই কাজটির প্রতি তাদের অনিহা দেখা যায়।

৪. অবাস্তব স্বপ্ন দেখা

পিটার প্যানরা মনে করে, স্বপ্ন দেখার মাধ্যমেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। আর তাই নির্দ্বিধায় অবাস্তব স্বপ্ন ও অলীক কল্পনায় দিন পার করতে থাকে তারা। কিন্তু তাদের কাজের পরিধি এই স্বপ্ন দেখা ও কল্পনা করাতেই সীমাবদ্ধ। সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করে না। কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হয় সে বিষয়েও তারা অপরাগ।

৫. লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব ও ঘরের কাজে উদাসীনতা

বাজার-সদাই করা, বিদ্যুৎ বা পানির বিল দেয়া, কিংবা ঘর মোছা, খাবার তৈরি করা — এ ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত থাকে পিটার প্যানরা। তারা আশা করে, তাদের সঙ্গী বা পরিবারের অন্যরাই তাদের হয়ে কাজগুলো করে দেবে।

৬. সম্পর্ক তৈরিতে অনীহা
একটি সম্পর্ক তৈরির সাথে আসে নানা ধরনের দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে খুব ভয় পায় পিটার প্যানরা। তাই যেকোন ধরনের সম্পর্ক স্থাপন কে তারা বাড়তি ঝামেলা মনে করে এবং এড়িয়ে যেতে চায়।

৭. স্মৃতিকাতরতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়
পিটার প্যানরা বর্তমানকে উপভোগ করে না, ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করতে ভয় পায়। বরং পেছন ফিরে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে, অতীতে তারা কত সুখী ছিল তা ভাবতেই বেশি পছন্দ করে।

৮. মাদকাসক্তি
পিটার প্যানরা কোনো দায়িত্ব পালন করে না ঠিকই, কিন্তু সেজন্য নিজেদের কাছেই তারা সবসময় ছোট হয়ে থাকে, আর বাস্তবতার কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্নও হয়। এই উদ্বেগ থেকে তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। ক্ষণিকের মানসিক প্রশান্তি ও বাস্তবতা থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে তাই তারা আশ্রয় খোঁজে মাদকে। এক পর্যায়ে তাদের মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

৯. অন্যদের দায়ী করা

পিটার প্যানরা নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার তারা নিজেরা নিতে চায় না। সেই দায়ও তারা অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতে চায়। বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা, জীবনসঙ্গী, সন্তান, অফিসের বস- সবাইকেই তারা নিজেদের শত্রু বলে মনে করে, এবং এই শত্রুদের কারণেই তারা জীবনে কিছু করতে পারেনি, এমন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে নিজেদের।

পিটার প্যান সিনড্রোমের কারণ
এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মনোবিজ্ঞানীরা এ ধরনের সিনড্রোমের পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করে থাকেন।

প্রথমত, যেসব শিশুকে ছোটবেলা থেকে বাবা-মা অনেক বেশি শাসনে বা আদরে রাখে, কিছু করতে দেয় না, তারা ক্রমশ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা ভাবে, তাদের কাজগুলো সবসময় অন্যরাই করে দেবে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তারা আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, যেসব শিশুদের ছোটবেলায় একা একা কাটে, কোনো সমবয়সী বন্ধুবান্ধব থাকে না, তারা নিজেদের তৈরি করা এক কাল্পনিক জগতে বিচরণ করে। বড় হওয়ার পরও তাদের পক্ষে সেই কল্পনার দুনিয়া থেকে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসা সম্ভব হয় না।

তৃতীয়ত, কোনো শিশু যদি ছোটবেলায় খুব বাজে কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, যেমন তার বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি চলে বা তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, কিংবা শিশুটি (ছেলে কিংবা মেয়ে) যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সে এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। তার মনে নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধে। এগুলো থেকে বাঁচতে সে নিজের মনেই এক ধরনের বিকল্প দুনিয়া তৈরি করে নেয়, যেখানে সে নিজেকে সুখী কল্পনা করে। এদিকে বাস্তব দুনিয়ার প্রতি তার মনে গভীর ঘৃণা বা ভীতি জন্মায়। তাই বাস্তব দুনিয়ার কারো সাথেই সে ভালো করে মিশতে পারে না, কোনো কাজ সহজভাবে করতে পারে না, কোনো দায়িত্ব গ্রহণের সাহস করে উঠতে পারে না।

পিটার প্যান সিনড্রোমে করণীয়
পিটার প্যান সিনড্রোম একটি মানসিক রোগ যার দায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের উপর ও বর্তায়। তাই আশেপাশে কোন পরিচিত শিশু এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করলে জানার চেষ্টা করতে হবে এমন আচরণের কারণ। ঘনিষ্ঠ হয়ে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। হতে পারে বিশ্বাসযোগ্য ও সহানুভূতিশীল কারো সান্নিধ্য তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। শিশুটির অবস্থা যদি খুব খারাপ হয়, তাহলে তাকে একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। কারণ একটি সুস্থ জীবন লাভের অধিকার রয়েছে সেই শিশুটির। আর সেই সুস্থ জীবন লাভে সাহায্য করতে পারেন মনোচিকিৎসকের।

স্টাফ রিপোর্টার/ ফাহমিদা হক মিতি

Platform:
Related Post