X

বিশুদ্ধ পানির পরীক্ষা গুজব!

প্লাস্টিকের চাল গুজবের পর এবার নিয়ে আসলাম বিশুদ্ধ পানির পরীক্ষা গুজব!

বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি কিছু ভিডিও শেয়ার হচ্ছে। সেখানে দেখানো হয় একজন কোন একটি বা একাধিক জনপ্রিয় মিনারেল ওয়াটার কোম্পানির বোতল থেকে পানি একটি গ্লাসে ঢালেন এরপর একটি ম্যাজিক টেস্টার বের করেন যার এক মাথায় দুটি ধাতব দন্ড থাকে আরেক মাথায় ইলেক্ট্রিসিটি সংযোগের জন্য প্লাগ। পানিতে ধাতব দন্ডগুলো ডুবিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি সংযোগ দেবার কিছুক্ষন এর মাঝেই সেই পানি ঘোলাটে বাদামী বর্ণ ধারন করে এবং পরীক্ষাকারী বলে দেখেন দাম দিয়ে কি পানি কিনে খাচ্ছেন, কত ময়লা এই পানিতে! এরপর সেই পরীক্ষাকারী তাদের বিশেষ প্রযুক্তির ফিল্টার মেশিন থেকে ফিল্টারকৃত পানি আরেক গ্লাসে নিয়ে একই পরীক্ষা করে দেখায় যে পানি ঘোলা হয়নি তাই এটিই পানি বিশুদ্ধকরণের সবচেয়ে ভালো উপায়, দাম একটু বেশি কারন ভালো জিনিসের দাম তো বেশি হবেই, সুস্বাস্থ্যের জন্য এটুকু খরচ করাই যায়!

ব্যাখ্যায় যাবার আগে বলে নেই এই পরীক্ষা দুনিয়ায় নতুন না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বিখ্যাত ব্র‍্যান্ডের মিনারেল ওয়াটারকে দূষিত ঘোষনা করার ধোকাবাজি অনেক আগেই অনেক দেশে হয়েছে এবং তারা সচেতন হয়েছে। ২০১২ সালে এমন ঘটনা আরব আমিরাতে ধরা পড়ে এবং কিভাবে এই জালিয়াতদের ধরা হয় সেটি এই লিংকে পাবেন (https://m.gulfnews.com/amp/news/uae/general/fraudsters-trapped-water-filter-scam-exposed-1.985003)

এইবার ব্যখ্যায় আসি। পানি একটি তড়িৎ পরিবাহী পদার্থ কিন্তু বেশি একটা ভালো পরিবাহী না। পানির মাঝে কি পরিমান আয়ন (আয়নগুলো আসে পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যেমন সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরিন ইত্যাদি থেকে) আছে তার উপর। আয়ন বেশি থাকলে ঐ পানির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ বেশি যাবে, কম থাকলে কম যাবে। সত্যিকারের মিনারেল ওয়াটারে এইসব খনিজ উপাদান অনেক থাকে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক তো নয়ই বরং উপকারী। এছাড়াও সাধারন ফিল্টার বা অন্যান্য পানি বিশোধন প্রক্রিয়া বিশুদ্ধকৃত খাবার পানিতেও এসব খনিজ উপাদান থাকে (খনিজ উপাদান মানে জীবানু না) কারন এসব আয়ন ফিল্টার হয়না বা ফুটালে যায়না। এই বিজ্ঞানটিকে ব্যাবহার করে ম্যাজিক পরীক্ষা করা হয়। যে জিনিস দিয়ে পরীক্ষাটি করা হয় তা একটি সাধারন ইলেক্ট্রোফোরেসিস যন্ত্র। এর মাঝে দুটি বা ৪টি ধাতব দন্ড থাকে যার একটা অংশ ইলেক্ট্রিসিটির পজিটিভ প্রান্ত (এ্যানোড) অন্যটি নেগেটিভ প্রান্ত (ক্যাথোড) হিসেবে কাজ করে। এ অবস্থায় যখন পানির মধ্য দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি পাস করানো হয় ঐ পানিতে আয়ন বেশি থাকলে ভালোভাবে ইলেক্ট্রিসিটি পাস হবে। ইলেক্ট্রিসিটি পাস হলে যা হয় তা হলো পানির পজিটিভ আয়ন (সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, হাইড্রোজেন) ইত্যাদি ঐ যন্ত্রের নেগেটিভ প্রান্তর দিকে ছুটে যায় আর নেগেটিভ আয়নগুলো (হাইড্রোক্সাইড, ক্লোরাইড ইত্যাদি) পজিটিভ প্রান্তে যায়। যন্ত্রটির পজিটিভ প্রান্তটি থাকে লোহার তৈরি। লোহা অক্সিজেন এবং হাইড্রোক্সাইডের সাথে খুবই দারুনভাবে বিক্রিয়াশীল এবং দ্রুত বিক্রিয়া করে ফেরিক অক্সাইড তৈরি করে। ফেরিক অক্সাইড পানিতে দ্রবীভূত হয়না এবং এর রঙ বাদামী। ফলে কিছুক্ষনের মাঝে পানি বাদামী রঙ এর “ময়লা” দিয়ে ভরে যায়! (যন্ত্রটির কি দিয়ে বানানো তার ভিডিও এই লিংকে পাবেন: https://m.youtube.com/watch?v=ASnLL6ebaco)

এবার তাহলে প্রশ্ন আসবে ওদের পানিতে কেন এমন হয়না। এমন হয়না কারন তারা যে প্রক্রিয়ায় পানি ফিল্টার করে তার নাম রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়া (বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Reverse_osmosis)। এই প্রক্রিয়ায় এইসব আয়ন এর পরিমান কমে যায় ফলে পানিতে দ্রবীভূত খনিজ এর পরিমান অনেক কমে যায় যা পানির বিদ্যুত পরিবহন ক্ষমতা কমায়। ফলে লোহার তৈরি ঐ দন্ডে যথেস্ট পরিমান হাইড্রোক্সাইড ও অক্সিজেন যেতে পারেনা বিক্রিয়া করার জন্য তাই “ময়লা” ও হয়না!!!

রিভার্স অসমোসিস পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য অবশ্যই একটি দারুন প্রক্রিয়া কিন্তু এটি অনেক খরুচে এবং অন্য কোন পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া কার্যকরী না এটাও সম্পূর্ণরূপে ভুল কথা। এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী তাদের ফিল্টার বিক্রি করছে মানুষের কাছে। এদের জালিয়াতি ধরতে একটা সহজ কাজ করতে পারেন তা হলো ওরা যে পানিতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখায় ময়লা নেই সেই পানিতে এক চিমটি লবন দিয়ে গুলিয়ে আবার পরীক্ষা করতে বলতে পারেন। এইবার যেহেতু পানিতে লবনের আয়ন থাকবে তাই পানিও ঘোলা হবে তখন প্রশ্ন করবেন দিলাম লবন বের হলো ময়লা ঘটনা কি?! এই উত্তর দেবার সামর্থ্য ওদের নেই। সুতরাং গুজবে কান্দিবেন না, পানি ফুটিয়ে বা অন্যান্য বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ করে খেতে থাকুন।

লেখকঃ ডা. মারুফুর রহমান অপু

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

Mahbubul Haque:
Related Post