X

বিয়ে মানে ধর্ষণের বৈধতা নয়!

১.
রাত ২ টা ৪৫। ডিউটি ডাক্তার সবে মাত্র বিশ্রাম নেয়ার জন্য ঘুম ঘুম চোখে চেয়ারে বসেছে। ইমারজেন্সি থেকে ফোন আসলো।
চোখের পাতায় ঘুম ঠেসে, ইমারজেন্সিতে এসে চমকে যাওয়ার অবস্থা। মহিলা রোগী, পড়নের চাদর রক্তে ভেজা। মুখের রঙ ফ্যাকাসে, সাদা।
কাপড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে।
কাগজে লেখা, রোগীর নাম ফুলি। হিষ্ট্রি নেয়ার জন্য ডাক্তার জানতে চাইল, কি হয়েছে?

রোগীর সাথে সদ্য বিবাহিত জামাই, জা এবং আরও দুই একজন এসেছে।
ডাক্তার দেখেই রোগীর বর চোরের মত, রুম থেকে বের হয়ে গেল। রোগীর সাথের মহিলা তেজের সাথে বলল, “ডাক্তার হইছেন, বুঝেন না কেরে, সব কইতে হইবো!”

২.

“মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ের বাদ্য বাজনা বাজে রে..”
গাছের মাথায় বাধা মাইকটিতে একের পর এক বিয়ের গান বেজে চলছে। বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত।
বর পক্ষের যারা এসেছে, কথা বার্তায় আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের চেষ্টায় ব্যস্ত। দর কষাকষি করার পরে, কনে পক্ষ থেকে যৌতুক হিসেবে যা পাওয়া গেছে, তা নেহাত কম নয়।
কিন্তু কম হয়ে গেছে কনের বয়স। বাচ্চা মেয়ে, নাম ফুলি বেগম, সবে মাত্র ১৪ পেরিয়ে ১৫ বছরে পড়েছে। মেয়ের বাবাও মোটামুটি ভাবে লাল শাড়ি পড়িয়ে মেয়েকে বিদায় দিতে পেরে খুশি।
মেয়ে হলে তো বিদায় দিতেই হবে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মেয়েকে পড়িয়েছে। কম কি! তাছাড়া, শোনা যাচ্ছে ছেলেও নাকি ভাল। আয় রোজগার বেশ। এমন ছেলে তো আর চাইলেই মেলে না।
বাড়ির উঠোনে বসে মুখে পান চিবুতে চিবুতে ছেলের মামা বলল, ‘এমন ছেলে কোথায় পাবেন মিয়া। তাছাড়া, ছেলে মানুষের একটু দোষ থাকলেও সমস্যা নেই, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।’

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, মেয়েকে নিয়ে আসা হল, তার নতুন ঘরে।

যে মেয়েটি সবে মাত্র জীবনের সংজ্ঞা শিখতে শুরু করেছে, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখতে যাচ্ছে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার আজ বাসর । পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে সতীত্ব যাচাই করার উৎসব। আর বিয়ে তো একটি সামাজিক বৈধতা মাত্র।

সমাজ অনেক এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের সময় মেয়ের মতামতটা এখনও  গৌণ ।
মেয়ের যদি মতামত না নেওয়া হয় বা পরিবারের কারও ধমকে মতামত দানের পর বিয়ে হয়, তাহলে তাকে ধর্ষণ না বলে উপায় নেই।
ফুলির ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে। কিন্তু বাসর ঘরে চিৎকার যে করা উচিত নয়, এতটুকু বুঝতে শিখেছে। হাত পা ছুড়ে বরের লালসার যজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসার মিথ্যে চেষ্টা।
সমাজ বিধীত ‘বর’, যখন আদিম পশুত্ব থেকে বাস্তবে ফিরে আসে, তখন ফুলি রক্তে ভেজা। তখনও ফিনকির মত রক্ত যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে সাদা ফাক্যাসে হয়ে আসছে মুখের রঙ!

৩.
হাসপাতালের বেডে অচেতন  শুয়ে আছে ফুলি।
যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে, ওর চোখে পড়েছিল যে, শ্বশুর বাড়ির লোকজন কানাকানি করে কথা বলছে। ব্যাঙ্গাত্মক হাসি তামাশা করছে। যেন সব দোষ ফুলির। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতেও ভয় করে। তারপর ইঞ্জিন চালিত গাড়ীর ইঞ্জিনের প্রচন্ড শব্দ। আরও এলোমেলো কিছু মুহূর্ত। কিছুক্ষণ পর, সাদা এপ্রোন পড়া একজন ডাক্তার এসে তার হাত ধরেছে। মনে আছে শুধু এতটুকুই।

ডাক্তার নার্সকে সাথে নিয়ে, ফুলি বেগমকে পরীক্ষা করলেন। ভয়াবহ রকমের পেরিনিয়াল টিয়ার (যৌনাঙ্গ ও তার আশ পাশ ছিড়ে গেছে)। তখনও রক্ত যাচ্ছে প্রচুর। হাতে পালস দেখা হল। খুবই কম। জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে রক্ত দেয়া দরকার। জরুরি অবস্থায় অপারেশন করে ছিড়ে যাওয়া অংশ অপারেশন করে ঠিক করতে হবে। নাহলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না আর রক্তশূন্য হয়ে শেষ হয়ে যাবে প্রাণস্পন্দন ।
এই ভয়াবহ সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা কর্তব্যরত ডাক্তারের।
ম্যাডামকে ফোন করা হল।
প্রাথমিক ভাবে ম্যানেজ করার জন্য রক্ত দরকার।
রোগীর সাথে যারা এসেছে এতক্ষণ ইমারজেন্সী রুমের সামনে চিল্লা পাল্লা করছিল। ডাক্তার এসে জানালো জরুরি ভিক্তিতে রক্ত দরকার। তখন সবাই চুপ। কেউ কেউ কেটে পড়ার জন্য পাশে সরে গেল। কিছুক্ষণ পর রোগীর লোক জানালো, তারা রক্ত জোগাড় করতে পারবে না। যা হয় হবে!
ডাক্তার তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হল না।
রাত সাড়ে তিনটায় ম্যাডাম আসলেন। তার ধমকে শেষ পর্যন্ত তারা রক্ত জোগাড় করতে রাজি হল। কিন্তু রক্ত আর সেই রাতে জোগাড় হল না।
অপারেশন থিয়েটারে ফুলিকে নিয়ে টিয়ার রিপেয়ার করা হল।
সকালে রোগীর শ্বশুর বাড়ির লোক সবাই উধাও। ফুলির বাবা আসলেন সেই সকালে, রক্ত জোগাড় হল কোনরকমে।

ছয় দিন পর, রোগীর সেপ্টিসেমিয়া ডেভলপ করলো। ইনফেকশন রক্তে ছড়িয়ে গেছে। ভাল অ্যান্টিবায়োটিক দরকার।
রোগীর বাবা এসে বললেন, তারা আর খরচ চালাতে পারবেন না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, কোন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে, তাহলে ঔষুধ কেনার খরচ কিছুটা বাচবে। কিন্তু, হাসপাতাল মানে তো, কাজকর্ম রেখে একজনকে রোগীর পাশে থাকতে হবে। রিলিজ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, যা হবার হবে।
রিলিজ নিয়ে ফুলিকে বাসায় নেয়া হল। আরও বেশি অসুস্থ হওয়ায় চারদিন পরে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিন ভোর ভোর সময়। একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করলো ফুলি। সেই  শেষ । আর খোলেনি সেই কিশোরী চোখ।এই সমাজের প্রতি ঘৃনায় চোখ জ্বল জ্বল করছিল কি না কেউ দেখেতে পায়নি। ভোরের স্বল্প আলোয় বিদায় জানালো জীবনের নিষ্ঠুরতাকে!
ফুলি একিউট রেনাল ফেইলরে মারা গেছে। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ডায়ালাইসিসের জন্য বলা হয়েছিল, তারা রোগী নিয়ে এত ঝামেলা করতে পারবে না।
শ্বশুর বাড়ি থেকে সেই বাসর রাতের পর, কেউ আসে নি। তাদেরই বা এত চিন্তা কি, একটা বউ মরলে দশটা বউ পাওয়া যায়!

(প্ল্যাটফর্মে নাসিমা সুলতানা পরশিয়া’র পোষ্ট থেকে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ব্যবহৃত নাম ছদ্ম নাম। ফুলি একা নয়, এরকম ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এই ঘটনা গুলো চক্ষু লজ্জার ভয়ে প্রকাশ হয় না। কিন্তু সচেতনতা জরুরী।)

ওয়েব টিম:

View Comments (51)

  • Imran Sami, পড়, বোঝার চেষ্টা কর,বিয়া করলেই বুঝনদার হউন যায় না বুঝছ??

  • "যে মেয়েটি সবে মাত্র জীবনের সংজ্ঞা শিখতে শুরু করেছে, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখতে যাচ্ছে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার আজ বাসর রাত। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে সতীত্ব যাচাই করার উৎসব। আর বিয়ে তো একটি সামাজিক বৈধতা মাত্র।"

  • বাল্য বিবাহ বন্ধ করা উচিত। কিন্ত বিবাহ মানেই ধর্ষনের বৈধতা একমত নই। বিয়ে মানে ভালবাসার সফল পরিসমাপ্তি।

  • পুরুষ নামক নরপশুদের একজন কিন্ত আপনার বাবা অথবা ভাই। সুতরাং মন্তব্য করার আগে একটু চিন্তা করুন। আর এখন তো নারীতান্ত্রিক সমাজ।

    • বাবা র ভাই হলেই তাদের সাত খুন মাফ???

    • তাহলে আগে তাদের বিচার করেন। নারীরা সবাই আইন করুন আর পুরুষকে বিয়ে করবেন না কারন তারা সবাই ধর্ষক।

    • সব পুরুষ কে বলা হয়নি। যাদের মাঝে পশুত্ব আছে তাদের বলা হয়েছে। সব ধর্ষক পুরুষ কিন্তু সব পুরুষ ধর্ষক নয়। কিছু মানুষ সব সময় নেকামো করবেই।

  • কি আর বলবো?? লজ্জা লাগে.. কষ্টও হয়...
    এবং দিনশেষে এই গ্লানি নিয়েই বাঁচতে হয়, "জ্বি,আপনি একজন অথর্ব.."

  • Hmmmm. Ami o ekta peyechi ei rokom case. Jodio seta ballo biye Chilo na. But perineal tear hoyechilo.

Related Post