X

বিএসএমএমইউ-এর উদ্যোগে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ

শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ৭ কোটি ২০ লাখার টাকার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান
আরো ৭২ শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু কানে শুনতে ও কথা বলতে পারবে, তাঁদের মা-বাবার মুখে ফুটবে হাসি।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন কর্মসূচী কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম, বিএসএমএমইউ-এর উদ্যোগে গত ১৮ জুন ২০১৭ ইং তারিখ, রবিবার, সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিলন হলে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ পত্র প্রদান করা হয়। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য লাখ লাখ টাকার ডিভাইস সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হয়। মোট ৭২ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ পত্র প্রদান করা হয়। প্রতিটি কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস-এর বাজারমূল্য ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইসসম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।

উক্ত মহতী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম, বিএসএমএমইউ-এর কর্মসূচী পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল হাসনাত জোয়ারদার। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নাক কান গলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান তরফদার, বিশিষ্ট কথা শিল্পী স্বপ্না রেজা, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী সামিনা চৌধুরী। পরিচালনা করেন নাক কান গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম জহুরুল হক সাচ্চু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশর সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যন্য সাধারণ মহতী সেবা কার্যক্রম হলো কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারী কর্মসূচী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আছেন বলেই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরাও লাখ লাখ টাকার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পেয়েছে। এরফলে আজ ওই সকল শিশুরা শুনতে পারছে, কথা বলতে পারছে এবং তাঁদের মা-বাবার মুখে হাসি ফুটেছে। আসলে একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু যখন কানে শুনতে পায় ও কথা বলতে পারে-এর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মাননীয় উপাচার্য বলেন, সকল ধরণের প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আন্তরিক ও বিশেষ নজর রয়েছে। তিনি বিরাট মানবিক গুণের অধিকারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার কারণেই আজ আর এসব শিশুরা সমাজের বোঝা নয়। সকল প্রতিবন্ধী শিশুকে সমাজের মূল স্রোত ধারায় নিয়ে আসতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্টে সহায়তা করার জন্য বিত্তশালীদের প্রতি আহ্বান জানান। মাননীয় উপাচার্য আরো বলেন, আসন্ন ঈদ উল ফিতরের আগে এ ধরণের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বরাদ্দ হলো প্রতিবন্ধী বান্ধব সরকার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ঈদের অমূল্য উপহার বিশেষ! সরকার, সামাজিক শক্তি, চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা একত্রে কাজ করলে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমাজের মূল স্রোত ধারার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য অচিরেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে স্পীচ ও হেয়ারিং সেন্টার চালু করা হবে।

অনুষ্ঠানে কর্মসূচী পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল হাসনাত জোয়ারদার জানান, বধিরতা বাংলাদেশে একটি বড় ধরণের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বধিরতার হার শতকরা নয় দশমিক ছয় ভাগ। দেশে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ মারাত্মক ধরণের বধিরতার ভুগছেন-যারা সকলেই কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের সম্ভাব্য প্রার্থী। বিশ্বজুড়ে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে দুইজন শিশু বধিরতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬০০ শিশু বধিরতা নিয়ে জম্মায় এবং প্রায় সমসংখ্যক জনগোষ্ঠী শ্রবণ শক্তি নিয়ে জম্মালেও তাঁদের জীবদ্দশায় কোন না কোন সময়ে বধিরে পরিণত হয়। শৈশবে এবং বাল্যকালে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা শিশুর মৌখিক ভাষার বিকাশ এবং মানসিক বিকাশকে সরাসরি বাধাগ্রস্থ করে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তি পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকে। তাই একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধীর দ্রুত শ্রবণ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মারাত্মক বধিরতা অথবা সম্পূর্ণ বধিরতা যেখানে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও কানে শোনা সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে এখন অন্তকর্ণেও কক্লিয়ায় স্থাপনযোগ্য জৈব ইলেকট্রনিক যন্ত্র কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অত্যন্ত উপযোগী ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অন্তকর্ণে স্থাপন করতে হয়। এই ইমপ্লান্ট শ্রবণ প্রতিবন্ধীর জন্য এক আর্শীবাদ স্বরূপ। এই ইমপ্লান্ট গ্রহণের মাধ্যমে এক শ্রবণ প্রতিবন্ধী শ্রবণের জগতে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারী এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশের হাতে গোনা তিন চারজন রোগী বিদেশে গিয়ে এই ইমপ্লান্ট সার্জারী করিয়েছেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ২৫ ইমপ্লান্ট সার্জারী হয়। বাংলাদেশে বর্তমান বাজারে একটি কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট -এর (ডিভাইস) মূল্য দশ লক্ষ থেকে বিশ লাখের মধ্যে পড়ে। এছাড়া সার্জারী, হেবিলিটিশন থেরোপী ও বিবিধ খরচের গড়ে কমপক্ষে আরো লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা সাধারণ মানুষের একেবারে নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়াও দেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট টেকনোলজি সহজলভ্য ছিল না। এই প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ডেভেলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (১ম পর্যায়ে) নামে একটি কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই কর্মসুচীর মূল লক্ষ্য ছিল শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস প্রদান করা, সার্জারী করে শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা, হেবিলিটিশন সেবা প্রদান করার শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে ইমপ্লান্ট পরবর্তী সময়ে ভাষা বা কথা বলা শেখানো এবং ইমপ্লান্ট বিষয়ে জনবল তৈরী করা ও টেকনোলজি আহোরন করা। এ পর্যন্ত সকল কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারী সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সকল অপারেশনও বিনামূল্যে করা হয়েছে। সকল ইমপ্লান্ট গ্রহীতারা কানে শুনতে ও কথা বলতে সক্ষম হচ্ছে। আজকের কর্মশালা দেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট টেকনোলজি ট্রান্সফার প্রক্রিয়াকে আরো অগ্রায়ণ করবে। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমবে এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা দেশেই সাশ্রয়ে এই আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে।

অন্য বক্তারা বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসার জন্য যে চাড়া গাছটি রোপন করেছিল আজ তা মহিরুহ আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে শিশুসহ ১৫২ জনের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক বলেই অত্যন্ত দামী কক্লিয়ার ডিভাইস সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫২ জনের কক্লিয়ারইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে ১৪০ জনই শিশু। ফলে ১৪০ পিতা-মাতা শুনতে পাচ্ছেন প্রিয় সন্তানের মুখে মা-বাবা ডাক এবং অন্য ১২ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধীও শুনতে ও কথা বলতে পারছেন। ১৫২ জনের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ সেবা পেয়েছেন ১২৮ জন এবং ২৪ জনকে নিজ অর্থে ক্রয় করা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস লাগানো হয়েছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। শুধুমাত্র ডিভাইস-এর মূল্য ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। বিদেশে এ ধরণের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বার্ষিক কর্মসূচীর আওতায় চলতি আজ আরো ৭২ জনকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বরাদ্দ দেয়া হলো। ফলে ওই সকল শ্রবণ প্রতিবন্ধীও শুনতে ও কথা বলতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের কারণে এই মহতী কার্যক্রম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য হাসপাতালগুলোতেও অনুরূপ কার্যক্রম চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানা গেছে। ৫ বছরের আগেই যদি শিশুদের বধিরতা ও কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের উপযোগিতা চিহ্নিত করা যায় তবে ইমপ্ল্যান্ট পরবর্তী ওইসব শিশুদের কথা শেখানো সহজ হয়।

Banaful:
Related Post