X

বঙ্গবন্ধু’র বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যভাবনা

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

১৯৭১ সাল। সদ্য জন্ম নেয়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন এক দেশ বাংলাদেশ। এই দেশটি পুনর্গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় দেশের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতই চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। দেশ গড়ার কাজে তিনি যে বিষয় গুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার মধ্যে স্বাস্থ্য ছিল অন্যতম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে প্রয়োজন একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুরুত্ত্ব প্রদানের পাশাপাশি গ্রহণ করেছিলেন সময়োপযোগী এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। মাত্র ৩ বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি এই দেশটিকে নিজের স্বপ্নের মত করে তৈরি করার জন্য। এই অল্প সময়ে তিনি কোন কালক্ষেপণ না করেই কাজ শুরু করে ছিলেন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠনের।

তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সংবিধানে চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ছিলেন সাধারণ জনগণের নেতা, তিনি দেখেছিলেন চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নগরের চেয়ে গ্রামের মানুষেরা অনেক পিছিয়ে আছে। এই অসামঞ্জস্য দূর করার জন্য তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জেলা ও থানা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি সারা দেশে ৩৭৫টি থানা হেলথ কমপ্লেক্স তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

স্বাধীনতার পূর্বে চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হতো না, বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব গ্রহণের পর চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির কারনে চিকিৎসকদের চাকরীর কোন নিশ্চয়তা ছিল না, তিনি চিকিৎসকদের চাকরির নিশ্চয়তা দেন। তাদের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ প্রদান করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শাস্ত্রের বিকাশের জন্য তিনি বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি চেয়েছিলেন আইপিজিএমআর (পিজি হাসপাতাল) কে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তুলতে। তিনি কলেরা হাসপাতালকে International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh (ICDDR,B) এ রুপান্তর করেন। মেডিকেল বিষয়ক গবেষণাকে উৎসাহিত করতেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল।

১৯৭৩ সালে তার প্রণীত পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ স্থান পেয়েছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা। তিনি চেয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে এবং অনুন্নত অঞ্চলে অধিক জন্মনিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে। তিনি জানতেন একটি সুস্থ জাতি তৈরিতে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনেক। তাই তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন নবজাতক ও মাতৃমৃত্যুর হার নিয়ে। তিনি মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার সংক্রমণ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণেও নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশ উন্নতির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি ক্ষেত্র শিল্প কারখানা, তিনি তাই চেয়েছিলেন শিল্প কারখানায় স্বাস্থ্যসম্মত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে।
সেই সময়ে যে হাসপাতাল গুলো ছিল সেগুলোর সুযোগ সুবিধা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তিনি সেসকল স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে তাদের সেবার মান বৃদ্ধি করেছিলেন কয়েকগুন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তি বাহিনির সদস্যদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য পৃথক হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন যক্ষ্মা, ক্যান্সার ইত্যাদির জন্য দেশেই বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলার।

শিশু কিশোরদের জন্য তাঁর হৃদয়ে ছিল বিশেষ স্থান, যার কারণে তিনি শিশুদের জন্য একটি ২৫০ বেডের হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।

কেবল স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরনই নয় তিনি ঔষধ ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিয়েছিলেন। তিনি ঔষধ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন যার কাজ ছিল অপ্রয়োজনীয় ও বেশি দামি ঔষধ আমদানি বন্ধ করা। এবং ঔষধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছিলেন। দেশেই ঔষধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তিনি কম দামে দেশের মানুষের জন্য ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। তিনি ঔষধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে একটি ঔষধ নিতিমালা প্রণয়ন করেন যা পরবর্তীতে জাতীয় ঔষধনীতি প্রনয়ন করার সময় ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ত্ব বিবেচনা করে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতির পিতার অবদান। এছাড়াও প্রতিবন্ধী সেবা থেকে শুরু রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ প্রিভেনটিভ, প্রোমোটিভ, কিউরেটিভ এবং রিহ্যাবিলিটেটিভ স্বাস্থ্যের প্রতিটি ধাপের উন্নয়নে তিনি গভীর মনযোগ রেখেছিলেন।

স্বাধীনতার পর মাত্র ৩ বছর সময় পেয়েছিলেন এই স্বপ্নের দিশারী। আজ হতে ১০০ বছর পূর্বে জন্ম নেয়া এই দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষটি চিন্তা চেতনায় ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক। এই দেশ গড়ার লক্ষ্য তিনি যে পদক্ষেপ গুলো নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার সব গুলোই তার আধুনিকতার প্রমাণ বহন করে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ গুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশ আজ তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ যেন কম খরচে আধুনিক চিকিৎসা সেবা পায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার স্বপ্নের পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়নের জন্য আজ তার সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

তথ্য সংগ্রহঃ
ডাঃ নাওমি নুর
ডাঃ আকতার হোসেন তানজিল
সম্পাদনাঃ
ডাঃ মোঃ রিজওয়ানুল করিম

অংকন বনিক:
Related Post