X

প্রতিরোধের মাধ্যমেই থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব

 

একটি শিশু কি জানত, এই সুন্দর পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে থ্যালাসেমিয়া রোগে ভুগবে? একটি মা কি জানত, তার সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হবে? কিন্তু কিছু দিন পর জানা গেল তার সন্তান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থ্যালাসেমিয়া নামক রোগ বহন করে যাবে। তার সন্তানকে আজীবন অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। একটু সচেতনতা কি পারতোনা এই শিশুর জীবন টিকে সুন্দর করে তুলতে?

 

থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) একটি বংশ গত রক্ত স্বল্পতা জনিত রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এই রোগ কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। জীন গত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্ত কণা উৎপাদন হয় না। একারণে তাদেরকে নিয়মিত রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়।
থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই প্রকারঃ
-আলফা থ্যালাসেমিয়া ও
-বিটা থ্যালাসেমিয়া।

পৃথিবীতে ২৫০ মিলিয়ন এর অধিক মানুষ থ্যালসেমিয়া রোগের বাহক। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ ভাগ মানুষই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার শিশু এই রোগে ভুগছে এবং প্রতি বছর গড়ে ৭ হাজার শিশু এই রোগ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে,আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রধান লক্ষনগুলো হলঃ রক্ত শুন্যতা, অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, অবসাদ অনুভব, দূর্বলতা, শ্বাসকষ্ট মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া,অস্বস্তি, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি।

 

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রতিমাসে একটি রোগীর পিছনে গড়ে ৭,০০০-২০,০০০ টাকা (বয়স/ঔষধ ভেদে) খরচ হয়, যা প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন, শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন অপসারনের জন্য নিয়মিত আয়রন চিলেটিং ঔষধ সেবনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এছাড়া বর্তমানে অস্থি মজ্জা (বোন ম্যারো) প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিকার করা যায় কিন্তু আমাদের মত উন্নতশীল দেশের জন্য এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

থ্যালাসেমিয়া একটি নীরব ঘাতক যা আস্তে আস্তে একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। প্রতিরোধই এই রোগের একমাত্র সমাধান। সচেতনতার মাধ্যমেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্য সকল রোগের মত এই রোগ প্রতিরোধ ব্যয় বহুল নয়। এই রোগের কোন প্রতিষেধক নেই। জীবনে এক বার ছোট্ট একটি রক্ত (Hb Electrophoresis Test) পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারবেন আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না? এই পরীক্ষাটি জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগের মত বার বার পরীক্ষা করা লাগে না, জীবনে মাত্র একবার করলেই হয়। যদি জানতে পারেন আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক তাহলে কখনোই আপনি আপনার নিকটস্থ আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ করবেন না। এছাড়া বিবাহের পূর্বে অবশ্যই আপনার স্ত্রীর Hb Electrophoresis Test করে নিবেন। বিবাহের পরও কোন দম্পতি যদি জানতে পারেন তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক তাহলে সন্তান নেয়ার পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়ার জীন থাকলে ভূমিষ্ট শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।

 

মনে রাখা জরুরী থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা রোগী নয়। তারা আপনার আমার মতই সুস্থ। যদি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যে কোন একজন বাহক হয় তাহলে তাদের সন্তানেরা বাহক হিসাবে জন্মাতে পারে কিন্তু কেউ রোগী হয়ে জন্মাবে না। একটু সচেতনতাই পারে আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ জীবন উপহার দিতে। আসুন আমরা সবাই মিলে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি এলক্ষ্যে আমরা নিজেরা থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানি অন্যদের জানাই।

 

 

 

 

বনফুল রায়
ইয়ুথ থ্যালাসেমিয়া এম্বাসেডর
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি

Banaful:
Related Post