X

নিয়মিত ব্যায়াম কোভিড-১৯ এ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ৮ জুন, ২০২০

লেখা:
অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন।
রিহ্যাবিলিটেশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ,
উপাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান,
ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে বেশি পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম (এক্সট্রা সেলুলার সুপার অক্সাইড ডিজমিউটেস) তৈরি হয়, যেগুলো কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুসের সংক্রমনে অতিরিক্ত পরিমাণে ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হওয়ার ফলে যে সকল জটিলতা সৃষ্টি করে সেগুলো কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।

> ব্যায়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

> ব্যায়াম মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।।

> নিয়মিত ব্যায়াম ঘুমের উন্নতি ঘটায়।

> ব্যায়াম ফুসফুস ও হার্টের কার্যকারিতা বাড়ায়।

> ব্যায়াম ওজন বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে।

★বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে কি ধরনের ব্যায়াম করবেন?

ক) সংক্রমনহীন সুস্থ ব্যক্তি এবং ১৮ বছরের উর্ধ্বে ব্যক্তিদের জন্যঃ

১) প্রতিদিন ৩০ মিনিট অথবা সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট তীব্র  মাত্রার ব্যায়াম করতে পারেন।

২) বাড়তি সুবিধার জন্য সক্ষম ব্যক্তিগণ প্রতি সপ্তাহে ৩০০ মিনিট পর্যন্ত মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করতে পারেন।

৩) সপ্তাহে ২-৩ দিন মাংস পেশির শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম করতে পারেন।

খ) বয়স্ক ও দূর্বল ব্যক্তিদের জন্যঃ

১) হালকা ব্যায়াম দিনে ১০-১৫ মিনিট করে দিনে ২-৩ বার করে করতে পারেন।

২) ভারসাম্য রক্ষার ব্যায়াম করতে পারেন।

গ) ৫ বছরের শিশু থেকে ১৭ বছরের যুবকদের জন্যঃ

১) দিনে অন্তত ৬০ মিনিট শারিরিক পরিশ্রম ও সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন পেশি শক্তি বৃদ্ধি করে এমন ব্যায়াম করতে পারেন।

ঘ) ৫ বছরের নিচে শিশুদের জন্যঃ

১) দিনে অন্তত ১৮০ মিনিট বিভিন্ন ধরনের যে কোন মাত্রার শারিরিক পরিশ্রম করতে হবে।

২) ৩-৪ বছরের শিশু মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার শারিরিক পরিশ্রম করতে হবে দিনে অন্তত ৬০ মিনিট।

ঙ) ১ বছরের নিচে শিশুদের জন্যঃ

১) অবশ্যই দিনে অনেকবার শরীর নড়াচড়া করে এমন কসরত করাতে হবে।

২) যারা এখনও বসতে-দাঁড়াতে পারে না তাদের অন্তত ৩০ মিনিট উপুড় করে শুয়ে রাখা ও বিছানায় বা মেঝেতে হাত-পা নড়াচাড়া করাতে হবে।

★মৃদু উপসর্গ হলে যে ব্যায়াম করতে হবেঃ

১) গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম (ডিপ ব্রেদিং

এক্সারসাইজ)

২) সোজা হয়ে বসুন।

৩) নাক দিয়ে জোরে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিন।

৪) ৩-৫ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন।

৫) মুখ দিয়ে শিস দেয়ার মতো করে একটু বাঁধা দিয়ে লম্বা শ্বাস ছাড়ুন

৬) উপরের প্রক্রিয়াটি ৫ বার করে করুন।

৭) ষষ্ঠবারে নাক দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে পূর্বের ন্যায় ৩-৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং শিষ্টাচার মেনে জোরে কাশি দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন।

৮) এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি ২-৩ বার করুন।

৯) অতঃপর ১০ মিনিট উপুড় হয়ে বুকের নিচে একটি বালিশ দিয়ে শুয়ে থাকুন এবং শুয়ে থাকা অবস্থায় গভীরভাবে শ্বাস নিন।

১০) দিনে ৩-৪ বার এই ব্যায়ামটি করতে পারেন।

১১) শরীর সক্ষম হলে প্রতিদিন ৩০ মিনিট হালকা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, তবে সমস্যা হলে অল্প সময় কয়েকবার হালকা হাঁটাহাঁটি করবেন।

১২) মৃদু উপসর্গ অবস্থায় সারাদিন বিছানায় শুয়ে না থেকে বসুন, দাঁড়ান, হাঁটাহাঁটি করুন এবং সক্ষমতা অনুযায়ী নিজের পরিচর্যা নিজে  করুন।

★ শ্বাসকষ্ট হলে যে ব্যায়াম করতে হবেঃ

ক) শ্বাস নিয়ন্ত্রন ব্যায়াম (ব্রেদিং কন্ট্রোল)

১) শ্বাসকষ্ট হলে আপনার শ্বাস দ্রুত ও অগভীর হয়, তাই সচেতনভাবে স্বাভাবিক শ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন।

২) চিৎ হয়ে মাথার নিচে কাঁধ পর্যন্ত ও হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে শান্ত হয়ে শোবেন।

৩) এক হাত পেটের উপর আরেক হাত বুকের উপর দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করুন।

৪) বুক ও কাঁধের প্রসারণ না করে শুধুমাত্র পেটের সামান্য প্রসারণের মাধ্যমে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করুন।

খ) ঠোঁট কাঁপানো ব্যায়াম (পার্সড লিপ ব্রেদিং)

১) নাক দিয়ে মুখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড শ্বাস নিন।

২) অতঃপর আস্তে আস্তে ৪-৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে শ্বাস ছাড়ুন।

৩) এভাবে ১০ বার করুন।

৪) ব্যায়ামটি দিনে কয়েকবার করতে পারেন।

★শ্বাসকষ্ট হলে আর যা যা করতে পারেনঃ

> আইসোলেসনে থাকা রুমের দরজা ও জানালা খোলা রাখুন।

> অক্সিজেন পাওয়া গেলে দিয়ে দেখতে পারেন শ্বাসকষ্ট কমে কি না।

> শ্বাসকষ্ট থাকা অবস্থায় বিশ্রামে থাকুন। তবে শুয়ে থাকা অবস্থায় শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করুন।

> বারবার গোড়ালি নড়াচড়া করুন।

> অনেকসময় শান্ত হয়ে বসে কাঁধ নিচু করে শ্বাস নিলে দুশ্চিন্তা কমতে পারে।

> সামনে ঝুঁকে হাত দিয়ে চেয়ার বা হাঁটুকে জড়িয়ে ধরে উপরের শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে শ্বাসকষ্ট কমতে পারে।

> এক চামচ মধু খেতে পারেন।

★ শ্বাসকষ্ট হলে বা অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে গেলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা তীব্র সংক্রমন বা সংকটাপন্ন রোগীর ক্ষেত্রে যা করতে হবেঃ

১) উপুড় করে ১২-১৬ ঘন্টা শুয়ে রাখা যেতে পারে।

২) হাত, পা ও শরীরের জয়েন্ট গুলো নড়াচড়া করিয়ে দেয়া।

৩) দুই ঘন্টা পরপর শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করিয়ে দেয়া।

★ তীব্র সংক্রমন বা সংকটাপন্ন রোগী সেরে উঠার পর্যায়ে যা করতে হবেঃ

১) শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম

২) ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি ব্যবহার করে শ্বাস প্রশ্বাসের পেশি সমূহকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।

★ ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি দ্বারা ব্যায়াম করার নিয়মঃ

১) চেয়ারে বা খাটের কিনারে পা ছেড়ে দিয়ে বসুন।

২) ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি মেশিনটি হাতে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস ছাড়ুন।

৩) মেশিনের মুখের অংশটি ঠোঁট দিয়ে শক্তভাবে ধরে রাখুন।

৪) আস্তে আস্তে যতটা সম্ভব গভীরভাবে শ্বাস নিন এবং মেশিনের বলের উঠানামা লক্ষ করুন।

৫) যতক্ষন সম্ভব শ্বাস ধরে রাখুন (কমপক্ষে ৫ সেকেন্ড)

৬) মুখ থেকে মেশিনের নলটি নামিয়ে ফেলুন।

৭) ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন।

৮) কয়েক সেকেন্ড বিশ্রাম নিন।

৯) উপরের প্রক্রিয়াটি ১০ বার করুন।

১০) ১০ বার করার পর ঝেড়ে কাশি দিন।

১১) দিনে কয়েকবার করুন

১২) ন্যাজাল-ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন নেয়া সচেতন রোগীও এই ব্যায়াম করতে পারেন।

১৩) রোগীর অবস্থা উন্নতির সাথে সাথেই ধীরে ধীরে বসানো, দাঁড়ানো ও হাঁটানোর চেষ্টা করতে হবে।

১৪) হাঁটার গতি বৃদ্ধি করুন

– প্রথম সপ্তাহ – ৫ মিনিট করে ৫ বার।

– দ্বিতীয় সপ্তাহ – ১০ মিনিট করে ৩ বার।

– তৃতীয় সপ্তাহ – ১৫ মিনিট করে ২ বার।

★ কখন ব্যায়াম বন্ধ করবেন?

> বুকে ব্যথা বা বুকে ধড়ফড় বা দুর্বলতা বা মাথা হালকা ভাব অথবা মাধা ঘুরালে ব্যায়াম বন্ধ করুন।

★ কোভিড রোগী কিভাবে শুবেন?

– বেশি সময় উপুড় হয়ে বা পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করবেন, তাতে ফুসফুসের জায়গা বৃদ্ধি পাবে।

– বেশিক্ষন চিৎ হয়ে শুয়ে থাকবেন না।

★সাধারন কিছু নিয়মঃ

> ঠান্ডা পরিহার করবেন।

> ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।

> নিয়মিত ঘুমাবেন ৬-৮ ঘন্টা।

> প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠার চেষ্টা করুন।

> দিনের বেলা ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। এতে রাতের বেলা ভাল ঘুম হবে।

> পরিবারের সাথে দুরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।

> নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে দিনে একবার তথ্য জানুন।

> বই পড়া ও টেলিভিশনে বিনোদন অনুষ্ঠান উপভোগ করুন।

> প্রতিনিয়ত আইসোলেসনে থাকা অবস্থায় সোস্যাল মিডিয়া, ভিডিও কল বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখুন।

> পালস-অক্সিমিটারের সাহায্যে রক্তে অক্সিজেনের পরিমান মূল্যায়ন করতে পারেন।

> সন্ধ্যার পর চা বা কফি পান থেকে বিরত থাকুন।

> যার যার ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করুন।

> সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করুন।

৬০ বছর বা তদুর্ধ ব্যক্তি যাদের অন্যান্য অসুস্থতা রয়েছে, এমন ব্যক্তিগণ কোভিড-১৯ রোগ মোকাবেলা করার জন্য ভিটামিন ও খনিজ জাতীয় ঔষুধ সেবন করতে পারেন।

– ক্যালসিয়াম ৫০০ মি.গ্রা. দুই বেলা।
– ভিটামিন ডি ১০০০-৪০০০ আইইউ প্রতিদিন।
– ভিটামিন সি ৫০০ মি.গ্রা. দুই বেলা
– জিংক ৭৫-১০০ মি.গ্রা. প্রতিদিন।
– মেলাটোনিন (Filfresh) ১-৩ মি.গ্রা. প্রতিদিন রাতে।

★ খ্যাদ্যাভ্যাসঃ

> সবুজ শাক-সবজি।

> টক জাতীয় খাবার যেমনঃ লেবু, আমলকি।

> ফল যেমন আপেল, কমলা, কলা।

> আমিষ জাতীয় খাবার যেমনঃ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল।

> প্রচুর পরিমানে তরল দিনে অন্তত ৩ লিটার পান করবেন।

বাহিরে প্রয়োজনীয় কাজে বের হলে যা করতে হবেঃ

– সঠিকভাবে মাস্ক পরুন।

– শারীরিক দুরত্ব (৩-৬) ফিট বজায় রাখুন।

– নাকে মুখে চোখে হাত দিবেন না।

– বারবার প্রয়োজন হলে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন।

– হাঁচি কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন।

– জ্বর বা কোভিড রোগের যেকোন উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করুন বা না করুন সাথে সাথেই হোম আইসোলেশনে থাকুন।

★ বাসায় যে সকল মেডিকেল সামগ্রী রাখা উচিতঃ

· মেডিকেল মাস্ক

· হ্যান্ড স্যানিটাইজার

· পাল্স-অক্সিমিটার

· ডিজিটাল বা নরমাল থার্মোমিটার

· ডিজিটাল বা সাধারন ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র

· ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি (শ্বাসের ব্যায়াম করার যন্ত্র)

· গ্লুকোমিটার

· নেবুলাইজার মেশিন বা সালবুটামল ইনহেলার সহ স্পেসার

Sarif Sahriar:
Related Post