X

ড্রিল মেশিন দিয়ে চিকিৎসা!

অষ্টম শ্রেণী পাস তিনি। কয়েক বছর আগেও মাছের ব্যবসা করতেন খুলনায়। নাম রতন কৃষ্ণ মজুমদার (৪৩)। তিনিই দিব্যি একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। হাসপাতালের নাম ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটি তার ভায়রা পাইক চন্দ্র দাস (৪২)-এর। এজন্য চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা না করেও চিকিৎসক বনেছিলেন রতন। যে ড্রিল মেশিন দিয়ে পাকা দেয়াল ফুটো করা হয়, তা দিয়েই হাড় ফুটোর কাজ করতেন তিনি। আর তার এসএসসি পাস ভায়রা পাইক তাকে এনেসথেসিয়া প্রয়োগে সহযোগিতা করতেন। শুক্রবার রাতে আলোচিত এই হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাঁচ সহযোগীসহ এই দুই ভুয়া চিকিৎসক রতন কৃষ্ণ মজুমদার ও বাবুল চন্দ্র পাইককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। পরে তাদের এক বছর করে কারাদ- ও এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের পাঁচ সহযোগী বাবুল চন্দ্রের স্ত্রী অন্তরা শিকদার (২৯), অফিস স্টাফ ইমাম হাসান (২২), জুয়েল মিয়া (২২), মাসুম বিল্লাহ (২২) ও শোভা বণিক (২৫)-কে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে সাত দিন করে কারাদ-ের আদেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সিলাগালা করে দেয়া হয়েছে মোহাম্মদপুর বাবর রোডে অবস্থিত ওই হাসপাতালটি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা। তিনি বলেন, যে ড্রিল মেশিন দিয়ে হাড় ফুটো করা হতো সেটি আসলে দেয়াল ফুটো করার যন্ত্র। হাড় ফুটো করার যন্ত্র ধীরে ধীরে ঘোরে। তিনি বলেন, এছাড়া হাসপাতালটি যথাযথ নিয়ম না মেনেই পরিচালিত হয়ে আসছিল। এজন্য সেখানে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা দেয়া হয়েছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার মধ্যরাতে র‌্যাব-২ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মোহাম্মদপুরের ১৬/১৪ বাবর রোডের ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই হাসপাতালে গভীর রাতে রতন কৃষ্ণ মজুমদার ও বাবুল চন্দ্র পাইক নিজেরাই ডাক্তার সেজে রোগীদের এনেসথেসিয়া প্রয়োগে অপারেশন করতেন। র‌্যাবের কাছে রতন কৃষ্ণ স্বীকার করেন, তিনি রোগীর পায়ের হাড় ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে টানা দেয়ার কাজটি করে থাকেন। ওই ড্রিল মেশিনটি একটি হার্ডওয়ারের দোকান থেকে কিনেছিলেন। ড্রিল মেশিনটির গায়ে লেখা রয়েছে ৩৫০০ আরপিএম অর্থাৎ এটি মিনিটে ৩৫০০ বার ঘুরে থাকে। কিন্তু হাড় ফুটো করার উপযুক্ত যন্ত্রটি ঘূর্ণনের হার অনেক কম থাকে। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, দেয়াল ফুটো করার এই যন্ত্রটি দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানুষের হাড় ফুটো করা হতো। এর ফলে হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতো। দ-প্রাপ্ত ভুয়া চিকিৎসক পাইক বাবু জানান, রতন যখন হাড় ফুুটো করতো তখন তিনি রোগীকে লোকাল এনেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ইনজেকশন দিতেন। অথচ এ ধরনের কাজের তার কোন প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা নেই। তার পরও তারা দীর্ঘ দিন থেকে নিজেরা চিকিৎসক সেজে অপচিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। র‌্যাব সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আসা সাধারণ রোগীদের গেট থেকেই ভুল বুঝিয়ে নিজেদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। এজন্য তাদের রয়েছে একটি দালাল চক্র। দালালরা রোগীর স্বজনদের বোঝাতো পঙ্গু হাসপাতালের বড় ডাক্তার এই হাসপাতালে বসেন। তাকে না দেখানো পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা সম্ভব নয়। দালালরা একজন রোগী ভাগিয়ে আনতে পারলে ৫০০ টাকা পায়। এছাড়া মোট বিলের ৩০ শতাংশ দালালরা নিতো। হাসপাতালের মালিক বাবুল চন্দ্র পাইক জানান, তার হাসপাতালের জন্য ২৫ থেকে ৩০ জন দালাল নিয়োগ করা রয়েছে। যাদের কাজই হলো পঙ্গু হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা। ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের নিয়মিত দালালরা হলো মোস্তফা, রত্না, মজনু, মনোয়ার, বাবু, আলামিন, জাকির, শরীফ, হাজেরা, ফাতেমা, মাকসুদা, বিল্লাল, জালাল, মজো, লুৎফর, মোহর, মিজান, রানা, কল্পনা ও মনিরের মা। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন আইন না থাকায় দালালি কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের মালিক ভুয়া চিকিৎসক বাবুল চন্দ্র পাইক আগে বিভিন্ন ক্লিনিকে ম্যানেজার ও পার্টনার ছিলেন। এরপর নিজেই ১০ বেডের হাসপাতালের মালিক হন। কয়েক মাস আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতালের লাইসেন্স নেন। তবে ৫০ শয্যার হাসপাতালে ১৫ জন ডাক্তার ও ৩০ জন নার্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ন্যাশনাল কেয়ার হাসপাতালে কোন নার্স ছিল না। সেখানে একজন সনদধারী ডাক্তার চিকিৎসাসেবা দিতেন। জটিল কিছু অপারেশনে ‘অনকূলে’ ডাক্তার এলেও হাসপাতালে বাকি সেবা অশিক্ষিত ওটি বয় এবং ওয়ার্ড বয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়া হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মূল্য তালিকা প্রকাশ্যে ঝোলানো বাধ্যতামূলক হলেও এই হাসপাতালে কোন মূল্যতালিকা ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো বিল আদায় করতো। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, হাড়ভাঙা রোগীর অপারেশনের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিল করতো। পায়ের অপারেশনের পর জামালপুরের ফরিদ (২২) নামে একজনকে ৯০ হাজার টাকা বিলের জন্য এক মাস ধরে এবং সিলেটের রূপ মিয়াকে কয়েক সপ্তাহ ধরে আটকে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সুনামগঞ্জের রিপন নামে এক রোগীর অপারেশনের জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা চুক্তি হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন আরও ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দাবি করে আসছে। এছাড়া প্রতি বেডের জন্য ন্যূনতম ৮০ বর্গফুট স্থানের প্রয়োজন হলেও তিন তলায় গাদাগাদি করে ৩২টি বেড আছে এ হাসপাতালে। কম্বল, বালিশ, বেডশিট রাখার স্টোর না থাকায় নোংরা বারান্দায় ফেলে রাখা হয় তা। এছাড়া পুরাতন এক্সরে মেশিনের কারণে আণবিক শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র না থাকায় মাত্রাতিরিক্ত রে বের হয়ে শরীরে ক্যানসার হতে পারে- এমনটিও আশঙ্কা প্রকাশ করেন অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তারা।

ওয়েব টিম:
Related Post