X

গল্পটা লোভ কিংবা ভালোবাসার

ভালবাসা দিবসের বিশেষ আয়োজনে থাকছে, গল্প- “গল্পটা লোভ কিংবা ভালোবাসার”

 

 

১৩ তারিখ সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ডাঃ জাবেদ সাহেব, ফিরেছেন গভীর রাতে । ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চুপ করে বসে আছেন তিনি । উনার স্ত্রী নীলিমা, ” তোমার সাথে একটু কথা আছে ” । “আজ না আমি খুব ক্লান্ত, মনটাও ভাল নেই । পাঁচবছরের একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে পারলাম না, হাসপাতালে আনতেই দেরী করে ফেলেছিল । জানো, বাচ্চাটা বাবামার একমাত্র সন্তান ছিল । উনাদের মুখগুলো চোখে ভাসছে । ” কথাগুলো বলেই একটা কাঁপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জাবেদ সাহেব । ” অনেক রাত হয়ে গেছে । ঘুমিয়ে পড়, কালসকালে তোমার সবকথা শুনবো লক্ষীটি ।”

 

সকাল ৬.৩০। জাবেদ সাহেবের ঘুম ভাঙলো, ফোনের শব্দে । ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় কেউ একজন বললেন, “স্যার ইমার্জেন্সী রোগী আইছে, তাড়াতাড়ি আসেন ”

ওকে আসছি, বলে ফোনটা রাখতে রাখতেই চোখমুখে পানি দিয়ে ছুটলেন ডাক্তারদের তীর্থস্থান, হাসপাতালে ।

 

সন্ধ্যা ৭.৩০।
“শরীরটা এবার বড্ড অবাধ্যতা দেখাচ্ছে । দেখাবেই তো, সারাদিনে এককাপ চা আর আর দুটো রুটি ছাড়া ও কে তো দেয়া হয়নি কিছুই । যাই ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে আসি ।”

 

বের হচ্ছিলেন জাবেদ সাহেব । ইমার্জেন্সীর গেটে আটকে গেলেন । জরুরী রোগী এসেছে, দেখেই যাই ।

এবারেরটা বাইক এক্সিডেন্ট । নাহ্, আজ সকাল থেকে সারাটা দিন যে কি হলো! এত্তো বাইক এক্সিডেন্ট কেন আজকেই ! মাঝখানে এক ছেলে এসেছিল বিষ খেয়ে, বিকালের দিকে আরেক মেয়ে এলো গলায় ফাঁসি নিয়ে। তার আগে আরেক মহিলা রোগী দেখলাম, জামাই মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।কারণ মহিলা নাকি বেড়াতে নিয়ে যেতে বলছিল । আজকে যত্তসব উল্টাপাল্টা কেইস আসছে ।
সব ভাবতে ভাবতে রাত নয়টা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলেন ডাঃ জাবেদ ।

লোকালবাসে বসে ঝিমুচ্ছেন, মাথাটাও ভীষন ধরেছে । বাস আটকে আছে জ্যামে । এমন সময় এই রাস্তায় এত্তো জ্যাম কেন ? কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি তো ! পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, রাস্তার মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ভালবাসা দিবসের অনুষ্ঠান করছে । কনসার্ট চলছে ।
ওহ্ আচ্ছা, এই ব্যাপার । যাক, তবু ভাল কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি । আজকাল যানবাহনে দূর্ঘটনা বড্ড বেড়ে গেছে ।

 

পলক ফেলার আগেই তিনি আবিষ্কার করলেন, আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী । ওহ্, নীলিমা একসপ্তাহ আগে থেকেই বলে রেখেছিল । দুজন মিলে কত্ত প্ল্যান করলাম, কিছুই হলোনা । বিয়ের পর এটাই প্রথম “ভ্যালেনটাইন ডে” ছিল । বাসায় গিয়ে যে কিভাবে সামলাবো। নিজের উপরেই চরম অসন্তুষ্ট হতে থাকেন ডাঃ জাবেদ ।
পরমুহূর্তেই স্বান্তনা দিতে থাকেন নিজেকে । আরেহ্ ভালবাসার আবার দিনক্ষন কি ! প্রতিদিনই তো ভালোবাসা যায় । তবে বিশেষ দিন যেহেতু আছেই, একটা উপহার তো দিতেই হয় । ভাবতে ভাবতেই বাস থেকে নেমে যান তিনি । গন্তব্য, ফুলের দোকান ।

ফুলের দোকানে গিয়ে পড়লেন আরেক সমস্যায় । নীলিমার গোলাপ পছন্দ, কিন্তু একটা গোলাপেরও সবগুলো পাঁপড়ি আস্ত নেই। গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয় গন্ধের জন্য, সেই ফুলেই এখন গন্ধ নেই । এরচেয়ে তো প্লাষ্টিকের ফুলই ভাল । মনে মনে বিরবির করলেন জাবেদ সাহেব ।

আচ্ছা ভাই, একটু ভাল দেখে একটা গোলাপ দিতে পারবেন ?
“ধূর মিয়া, সারাদিন কই আছিলেন ! শেষরাইতে আইছেন গোলাপ নিতে, এরচেয়ে ভালা আর নাই । দেহেন” তাচ্ছিল্যপূর্ন উত্তর দোকানির।

পাশেই বেলীফুলের মালা চোখে পড়লো । কিছুটা শুকিয়ে গেছে, তবে ঐ গন্ধহীন-পাঁপড়ীভাঙা গোলাপের চেয়ে ভালো । এটার অন্তত গন্ধ, আর পাঁপড়ী দুইই আছে ।

 

ডাঃ জাবেদ সাহেব যখন তার বাসার দরজায় তখন রাত ১০.৩০ ।
নীলিমা দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেল ।
নাহ্, মনে তো হয়না রাগ করেছে । রাগ করলে দরজা খুলেই ঝাড়ি দিতো, একবছরের যতবার রাগ করেছে ততবারই তাই করেছে । যাক্ বাবা ! এবার ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বললেই হবে।

তবে, প্রতিদিন দরজা খুলে দেয়ার পর একটা মুচকি হাসি দেয়, আজ শুধু সেটা নেই। কেন ?

 

উপরের গল্পটি কাল্পনিক । তবে পেশাগত চরিত্র, পরিবার এবং জীবনপ্রবাহ একেবারেই বাস্তব । বাস্তবতার এই জীবনপ্রনালী চলমান রাখতে গিয়ে একজন চিকিৎসক আদর্শ স্বামী হতে পারেন না । হতে পারেননা আদর্শ সন্তান কিংবা সন্তানের আদর্শ পিতা। 

 

“এতোকিছুর পরও জাবেদ সাহেব একজন লোভী ডাক্তার । “

 

এই লোভ একজন মৃত্যুপথযাত্রীকে জীবনে ফিরিয়ে আনার লোভ।  এই লোভ একটি অসুস্থ্য শিশুকে সুস্থ্য করে মায়ের কোলে তুলে দেবার লোভ। এই লোভ অপারেশনের পর রোগীর মুখে ভালবাসার এক চিলতে হাসি দেখার লোভ। এই লোভ একজন যন্ত্রনাকাতর রোগীকে ভালবেসে দিনরাত এক করে সেবা দেয়ার লোভ । এই লোভ বড় কঠিন লোভ, বড্ড কঠিন…….

হায় লোভ , হায় ভালবাসা।

 

 

 

লেখক : অমিত ঘোষ, তায়রুন্নেসা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ,সেশন-২০১৩/১৪
ছবি কৃতজ্ঞতা : আল জাবির চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation
Related Post