X

বাংলার কূটনীতি পেরিয়ে আসবে ভ্যাকসিন নাকি শেষ রক্ষা ন্যাচারাল ইমিউনিটিই!

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার

ডা. কাওসার উদ্দিন                                            ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কে- ৬৫

“পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো এই ঘরের মালিক নই!”

আমাদের অবস্থা এমনই। পরের ধনে পোদ্দারি। কি রকম সেটা? যেমন ধরুন সুদে হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে অনেক কিছু করা। কিন্তু দুর্নীতি রোধ করে কম খরচে যে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে বরাবরই সবার নজর কম। কারণ এতে দেশের লাভ হলেও, নিজের লাভ কম, জনগণের মাথার উপর থাকুক না ঋণের বোঝা, তাতে কার কি আসে যায়! এরপর হল, এই যেমন বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন প্রদানে আমাদের বহু অর্জন স্বীকৃতি থাকলেও, নিজেদের কোনো ভ্যাকসিন উৎপাদনে সাফল্য শূন্য। দেশে অনেক ভার্সিটিতে বায়োটেকনোলজি পড়ানো হয়, মেডিকেল কলেজে পড়ানো হয় এর সাথে সম্পর্কিত মেডিকেল সাইন্স এর অনেক কিছু, কিন্তু এ নিয়ে এদেশে গবেষণা নাই বললেই চলে। তারপর এই ধরুন ওষুধ কোম্পানি। আমাদের এত এত কোম্পানি যে আমরা গর্বে গর্বিত! নিজেরা কম দামে ওষুধ পাই, এমনকি দেশের বাইরেও পাঠাই। কিন্তু এটাও বাইরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট! কি রকম? ওষুধের কাঁচা মাল বেশিরভাগই আসে চীন, ভারত থেকে, অল্প কিছু আসে ভাল সোর্স থেকে, আর আমরা সেগুলো প্যাকেট করে বিক্রি দিয়ে বাহাদুর। নিজস্ব কারো রিসার্চ মলিকুল্স নাই, যদিও আমাদের অনেক সরকারি বেসরকারি ভার্সিটিতে ফার্মাসি পড়ানো হয়।

মাঝেমাঝে বহু সরকারি কর্মকর্তাকে সরকারের টাকায় পাঠানো হয় বিদেশে, পড়াশুনা করবে, পরে অর্জিত জ্ঞানে অবদান রাখবে এদেশে। অন্য সরকারি কর্মকর্তারা কতটুকু কি অবদান রাখে জানিনা, তবে তাদের অনেকে তাদের অর্জিত বৈদেশিক জ্ঞান আর নীতিনৈতিকতা এদেশে ফিরে এসে শিকেয় তুলে রাখে, ব্যস্ত হয় আগের নিয়মে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। ভার্সিটির অনেকে আর ফিরেই আসেনা। আর ডাক্তার, সবার কথা জানি না, সরকারি টাকায় অনেকে যাওয়ার সুযোগ পায় বহুবিধ পরিচয়ে, বাবার পরিচয়ে, ভাইয়ের পরিচয়ে, রাজনৈতিক পরিচয়ে, ফিরে আসার পর শুধু নামের পরে একটি ডিগ্রী বাড়ে শুধু, গবেষণা বা নতুন কোন অবদানে তাদের অবস্থান ঠিক সেই আগের মত! তো যা বলছিলাম আর কি, আমাদের দেশে ইদানিং কান্নাকাটি চলছে ভ্যাকসিন নিয়ে, কবে পাব? কিভাবে পাব? কাদেরটা পাবো? টাকায় পাবো না ফ্রি তে পাবো? আদৌ পাবো তো, যাদের থেকে পাবো তাদের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি নিয়ে। অর্থাৎ ভিক্ষার থালা নিয়ে তীর্থের কাকের মত বসে আছি। কেনই বা বসে থাকবো না? আমাদের এত এত ওষুধ কোম্পানি, তারা লাখ টাকা দিয়ে বেতন দিয়ে শুধু ফার্মাসিস্ট ডাক্তার রেখেছে, আর বাইরের মাল এদেশে এনে প্যাকেট করে শুধু বিক্রি করেছে, বিক্রি বাড়াতে খরচ করেছে শুধু ডাক্তারদের এটা- সেটা গিফ্ট দিতে। কিন্তু গবেষণায় যে কিছু বিনিয়োগ করা উচিৎ তারা সেটি কখনো চিন্তা করেনি, কেনই বা করবে, ওই যে বলেছি এদেরও হল পরের ধনে পোদ্দারি করার স্বভাব! মাঝে কি দেখলাম? নাটক দেখলাম! কান্নাকাটি করে একজন এসে বুক ভাসালেন, আমরা আশাবাদী হলাম, পরে জানলাম তিনি ছিলেন মুখপাত্র মাত্র, ভ্যাকসিন গবেষণার ক্ষেত্রে তার কোন সম্পর্ক নাই। মশা বলে কত জল, হাতি ঘোড়া গেল তল! এদেশের প্রথম শ্রেণীর ওষুধ কোম্পানিগুলোর এ নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা নেই, কাজ করুক বা না করুক তারা ব্যস্ত আমদানিকৃত ফ্যাভিপিরাভীর বা রেমডিসিভির প্যাকেটজাত করতে, আর ওদিকে কোনো এক থার্ড ক্লাস ওষুধ কোম্পানি যাদের ২০ মিলিগ্রাম অমিপ্রাজল থাকে নাকি মাত্র ৫ মিলিগ্রাম যা বলেছিলেন এক ফার্মাকোলজির স্যার তাদের ল্যাবে পরীক্ষা করে, সেই কোম্পানিই নাকি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছে। দিন তো অনেক পার হলো, কিন্তু আর কোনো খবর নাই! কোম্পানি যাই হোক, দেশবাসী কিন্তু ঠিকই আশায় বুক বেঁধে ছিল!

বাদ দিই এসব আলাপ, এখন আসি ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে। ‘নিজে বাঁচলে, বাপের নাম’ এদেশের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ। তাই এটাই স্বাভাবিক, যারা ধনী দেশ, বহু টাকা ভ্যাকসিন গবেষণায় ব্যয় করছে, কোম্পানিগুলোও যাদের দেশের, কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি হলে তারাই আগে পাবে, টাকা যারা বিনিয়োগ করেছে তারপর তারা পাবে, আর এরপর আমাদের মত গরীব দেশ, যাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে ভ্যাকসিন কিনতে দানের টাকায় বা যে ভ্যাকসিন মাত্র ট্রায়াল এ যাচ্ছে তার গিনিপিগ হওয়ার জন্য। তাই ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের কান্নাকাটি কম করাই ভাল, হোক দেরী, যা যখন পাই তাতেই লাভ! ভ্যাকসিন কূটনীতি করে লাভ কি? যেখানে আমাদের মাথাভর্তি কূট নীতি দিয়ে, যে নীতিতে আমরা এদেশে একে অপরের পিছে লেগে থাকি। কোথাকার কি গবেষক চিন্তা, আমাদের জ্ঞানী জ্ঞানী ছাত্রদের অনেকে ব্যস্ত থাকে মুখস্ত বিদ্যার পারদর্শিতা বা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রদর্শনে। বাকি জীবন তাদের এভাবেই যায়, রাজনীতি, পোস্টিং নীতি, তেলবাজি নীতি, সুবিধাবাদী নীতি, চেম্বার নীতি, নিজের সুখে থাকা নীতি, বড় বড় অনেক মাথাদের যে গবেষণা নীতি থাকার কথা ছিল তা আর এদেশে খুঁজে পাওয়া যায় না! ফলাফল অন্যের কাছে হাত পাতা, খিচুরি রান্না শিখতেও বিদেশে যাওয়া! ইন্ডিয়ার অনেক লোক মাঠেঘাটে পায়খানা করে, এ নিয়ে আমাদের অনেকে নাক সিঁটকায়, কিন্তু যদি হিসাব করি বহুদিক থেকে আমরা ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে। গবেষণায় ১০০ কোটির বেশি মানুষের দেশের যে উন্নতি সে তুলনায় আমাদের অবস্থান মাইক্রোস্কোপিক! ওদের ইন্ট্রা ন্যাসাল ভ্যাকসিন ‘কোভ্যাক্সিন’ এর ফেইস ৩ ট্রায়াল শুরু হচ্ছে আগামী মাসের শুরুতে। ফেইস ১ ও ফেইস ২ এর ফলাফল আশাব্যঞ্জক। ভারত বায়োটেক এই ভ্যাকসিন তৈরিতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিচ্ছে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন থেকে। সব মিলিয়ে এটা তাদের অনেক বড় অর্জন। আর আমাদের আশার খবর হল, ড্রাইভার মালেককে আবিষ্কার, যে মহিরুহ হয়েছে আবার আমাদেরই করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্নীতিতে! তাই আমাদের ধ্যান- জ্ঞান, গবেষণা, স্ট্যাটাস সব সমসাময়িক কালের মহা আবিষ্কার ড্রাইভার মালেককে নিয়ে! আমাদের দেশের করোনা আছে শুধু হাসপাতালে। কাউকে কল করলে বিরক্তিকর করোনা সতর্কতার কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা, আরে ভাই এক কণ্ঠতো বহুদিন শুনলাম, এবার একটু পাল্টান, লোকজন নতুন কিছু শুনে আর একটু গুরুত্ব দিবে। কারণ মাঠেঘাটে লোকজনের চালচলন দেখে দেশে যে করোনা আছে তা ঠাহর করাই দায়! যেখানে আজই মারা গেছে ২১ জন, নতুন আক্রান্ত ১৩’শ জনের বেশি, যেখানে টেস্ট হয়েছে ১২ হাজারেরও বেশি। মানুষ টেস্ট যতটকু যা করছে, কিন্তু টেস্টের মান কতটুকু কি ঠিক আছে সেটাই হল বড় প্রশ্ন। কেন এ প্রশ্ন তার একটি উদাহরণ দিই, ডিফেন্সের ১৫ জন কর্মকর্তা যাবে চীনে, যাওয়ার আগে তাদের সবার করোনা টেস্ট নেগেটিভ, কিন্তু যাওয়ার পর এয়ারপোর্টে থেকে নেমে নিয়মানুযায়ী আবার টেস্ট করা হল, ৭ জন পজিটিভ! স্যাম্পল কালেকশন এ হয়তো কিছু ঝামেলা আছে, আর এ কারণে আজ পজিটিভ তো কালই নেগেটিভ কি অদ্ভুত কাজ কারবার!

যাই হোক, আমাদের নিজেদের ভ্যাকসিন না থাক, অন্যদের থেকে শীঘ্রই ভ্যাকসিন পাই বা না পাই, আমাদের আছে নিডো! মানে হার্ড ইমিউনিটি! শুরুতে আমরা যেভাবে লকডাউন আর ট্রান্সপোর্ট নিয়ে লুকোচুরি খেলে ঝালমুড়ির মত এদিকের মানুষকে ওদিকে মাখিয়েছি তাতে আমাদের অনেকেরই যে ন্যাচারাল ইমিউনিটি হয়ে বসে আছে তা বলাই বাহুল্য। এ সম্পর্কে দিল্লীতে করা একটি সার্ভের কথা বলতে হয়, তারা উদ্দেশ্যহীন এন্টিবডি টেস্ট করেছিল সাধারণ মানুষের উপর যাদের কোন লক্ষণ ছিল না, ফলাফলঃ বহু মানুষের শরীরে কোভিড এর বিরুদ্ধে এন্টিবডির উপস্থিতি। ভ্যাকসিন যেদিনই পাই না কেন, তার আগ পর্যন্ত আমাদের সবেধন নীলমণি হল এই ন্যাচারাল ইমিউনিটি।

ইন্ডিয়ার আবিষ্কার ফেলুদা কিট আছে, আর আমাদের আছে সেফুদা! বড় বড় সেফুদাদাদের কাছে নিজ দেশের আবিষ্কৃত এন্টিবডি কিটের চার আনা মূল্য নাই, বরং আমাদের কিছু রাজনৈতিক বাতিকগ্রস্ত বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে যা বলার যা কিছু করার তার সবটাই করেছে! সেই সেফুদারা নিজেরা কিছু আবিষ্কার করে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করে ফেলেছে এমনটা আমার জানা নাই, কিন্তু একটি গবেষণাকে সর্বশক্তি দিয়ে মাটিচাপা দিয়েছে, সেই সাথে নষ্ট হয়েছে এদেশে অনেকের গবেষণার মানসিকতা! আমরা করবো জয় একদিন! এভাবেই?? হয়তো এভাবেই!!!

 

Silvia Mim:
Related Post