X

করোনার দিনগুলোয় ১৩ || আমরা কিভাবে আক্রান্ত হয়ে যাই

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুলাই ২০২০, সোমবার

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

সেদিন ছিলো অনেক কোভিড -১৯ পজিটিভ। কয়েকজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে দেখতে  তাদের বাড়ি যাই। প্রথম বাড়িতে দেখি একজন মহিলা রোগী, যার আবার ডায়াবেটিস আছে। তাঁকে একটি ঘরে আলাদা করে রাখা হয়েছে ইতিমধ্যে।ডায়াবেটিস শুনে আমি একটু ভড়কে যাই কেননা কো-মরবিডিটি যাদের থাকে তারাই বেশী সমস্যায় পড়েন। তিনি ইতিমধ্যে কয়েক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে বারো ঘাটের চিকিৎসা এবং এতোদিন যাদের সাথে থেকেছেন তাদের সবাইকে তিনি ছড়িয়েছেন সন্দেহ নেই। মহিলারা যেহেতু বাইরে যান না সহজে, তাই ধরে নিচ্ছি পরিবার প্রধান বাজার থেকে করোনা নিয়ে এসেছেন অথবা সামান্য সর্দিকাশির চিকিৎসা নিতে গিয়ে ঔষধের দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া অন্য কোন সোর্স আমরা পাইনি। সেদিন ডা. তৌহিদও আমার সঙ্গী ছিলেন।

পরের রোগীকে দেখতে গিয়ে আমি পুরোপুরি হতাশ। যিনি দেখাতে নিয়ে এসেছেন তিনি নিজেই মাস্ক পরেন নি। তিনি বৃদ্ধ রোগীর পুত্রবধূ। যৌথ পরিবারে সবাই একসাথেই থাকেন। বৃদ্ধ বিছানা আশ্রিত। তাঁকে আরেক ঘরে দেয়া হয়েছে। পচাঁশি বছর বয়সে তিনি আর হাটতে পারেন না। সর্বক্ষণ অন্য কেউ দেখাশুনা করতে হয়। কথা বলে বুঝলাম তিনি যথেষ্ট এলার্ট। শরীর কুলোয় না তবে শুয়ে থেকেও বললেন তিনি ভালো আছেন। আমরা যদি অগ্রিম ট্রায়েজ চিন্তা করি বৃদ্ধ নিঃসন্দেহে বাদ পরে যাবেন। আর তাছাড়া তাঁকে নিয়ে আমরা হাসপাতালেও তেমন কিছু করতে পারবো না। আবার সার্বক্ষণিক একজনের সাপোর্ট দেয়া একেবারে অসম্ভব। এমন ডেডিকেটেড স্টাফ আমরা এখনো তৈরী করতে পারিনি, আবার যে পরিমান স্টাফ আছে তা দিয়ে কখনোই সম্ভব নয় এই বৃদ্ধকে সাপোর্ট দেয়া। আমাদের আয়া, ওয়ার্ডবয়ও মনে করে, সে বড় লাটের বংশধর। তাই মানুষকে সাপোর্ট দেয়ার চিন্তাই করা যায় না। তাই রোগীকে বাড়ি রেখেই চিকিৎসা দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে আসলাম। এখানে পরিবারের সাপোর্ট ভালো পাবেন।

আমরা কোথাও যখন হাসপাতাল নিয়ে কোন আলোচনা সভায় বসি, তখন সবাই ইউরোপ আমেরিকার উদাহরন টানেন। বিশেষত নেতারা এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থরাই বেশী উদাহরন দেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তো বললেন বিদেশী হাসপাতাল মসজিদের মতো সুন্দর এবং পরিষ্কার কিন্তু আমাদেরটা নয় কেন!

উত্তরটা কিন্তু তাঁর কথাতেই আছে।

বিদেশ যাবার কথা ডাক্তারের, আপনি গেলেন কেন? তিনি দাবী করেছিলেন তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিএস হিসেবে বিদেশ ভ্রমনে গিয়ে দেখে এসেছেন। তারা অবশ্য কোন ডাক্তার পাঠাতে উৎসাহ বোধ করেন না।

একথা কিন্তু জিজ্ঞেস করা যাবে না তাকে। সরকারী সুবিধায় কতজন ডাক্তার বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ পায় বলতে পারেন কি? আমি পার করলাম ১২ বছর কিন্তু কোন সরকারী ভ্রমনের অভিজ্ঞতা হয়নি। কাজেই ওরা কিভাবে হাসপাতাল সুন্দর রাখে  আমার জানারও কথা নয়। তবে মন্ত্রণালয়ের আমার বয়সী সবাই জানার কথা।

আবার নেতারাও জানেন কত পারসেন্ট বাজেট স্বাস্থ্য সেক্টরে দেন। রোগী প্রতি ডাক্তারের অনুপাত কত হয় সরকারী হাসপাতালে। তারা আসলে সব না জানার ভান করে সব দোষ ডাক্তারের উপর চাপিয়ে দেন। পাব্লিকও এটা খায়। আমার তিন বিল্ডিং এর হাসপাতালে যদি তিনজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থাকে তবে প্রতিবেলা পরে একজন করে ডিউটি। পুরোটা পরিষ্কার রাখতে হলে একজন কর্মীকে পুরো ডিউটি পিরিয়ড ঝাড়ু হাতে ঝুঁকে থাকতে হবে। তবুও সম্ভব হবে না হাসপাতাল পরিষ্কার রাখা। কারন একবার ঘুরে আসতে আসতে আবার ময়লা করে ফেলবে লোকজন। এইকর্মী দরকার কমপক্ষে নয় জন। প্রস্তাব দিলেই মন্ত্রণালয়ে কেটে দিবে এই সংখ্যাটা।আবার হাসপাতালও মসজিদের মতো সুন্দর চাই। হিপোক্রেসি কিন্তু একেই বলে।

আমি নিজস্ব ব্যবন্থাপনায় তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিয়েছি স্বল্প বেতনে। উপজেলা পরিষদ থেকে বারে বারে চেয়েও পাইনি। আবার তারাই কিন্তু মিটিং এ পরিচ্ছন্নতার কথা বলেন, কিন্তু কোন খরচ করবেন না। ব্যাপারটা এমন তোমার কাজ পরিচ্ছন্ন রাখা, আমার কাজ সমালোচনা করা। কোন কর্মীর ব্যবস্থা করবেন না তারা। কোন খরচও করবেন না।

আমরা যারা ডাক্তার, তারা এই যুদ্ধের কমান্ডার। এর বিন্যাস হবার কথা যুদ্ধের মতোই। আমার পিছনে বেশ কিছু অফিসার থাকবেন। অফিসারদের সাথে অনেক সৈনিক থাকবেন। এই বিন্যাসে কোন সৈনিক দেখতে পাচ্ছেন কি আপনারা?

অফিসারের চেয়েও সৈনিকের সংখ্যা কম। কিভাবে এই যুদ্ধে জয় সম্ভব? ডাক্তার নার্স অনুপাত হবার কথা ১:৩, এদেশে এটি ২:১ আছে। প্রচুর ওয়ার্ড বয়, আয়া, পরিচ্ছন্নতা কর্মী দরকার। এতো বেশী ডাক্তার দরকার হয় না, দরকার হয় সাপোর্টিভ স্টাফ। স্টাফ ভালো থাকলে, ভালো স্বাস্থ্য সার্ভিস দেয়া সম্ভব। আবার স্টাফরা অদক্ষ আমাদের দেশে। তাদের কোন ট্রেনিং স্কুল নেই।

আর রাজনীতিবিদরা যদি কোন সরকারী কর্মচারীর জন্য কোন প্রমোশন, পোস্টিং নিয়ে তদবির না করেন তবে আমরা অনেক কিছুই কন্ট্রোল করতে পারি। ছোট ছোট গ্রেডের কর্মচারীরা ভাই বলে এমপিগনকে, যেখানে আমরা অফিসাররা স্যার বলে সম্বোধন করি। এই ভাই বলাটা আমাদের জন্য কাল হয়। ভাই বলা কর্মচারীরা কোন কাজ করতে চায় না। সে ক্লিনার হোক কিংবা স্বাস্থ্য পরিদর্শকই হোক।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো একটি টিনেজ রোগী, যাকে আমি দেখেই কোভিড টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি আলিশান বিল্ডিং। তারা আবার থাকে চার তলায়। তার বাবা এবং আরেক চাচা আমার সঙ্গী হলেন। চার তলায় গিয়ে রোগীকে আবিষ্কার করলাম দরজা খোলা এবং মাস্কবিহীন। এই ঘরে ছোট বাচ্চাও আছে। কি অদ্ভুত! ওরা মিনিমাম কোন নিয়মকানুনও মানছে না, কারন তাদের তেমন বেশী কোন লক্ষণ নেই। সামান্য জ্বর, কাশি, গলাব্যাথা। অথচ তাদের ঘরে বেশ কয়েকজন ডায়াবেটিক রোগী আছেন। রোগী দেখা শেষ করে তাদের পরিবারের বাকি সবার হিস্ট্রি নিলাম। সবার মধ্যেই কোভিড এর লক্ষণ আছে। বউ, মা, ভাই, বাচ্চাকাচ্চা সবারই লক্ষণ আছে।

তক্ষুনি আমার চিকন ঘাম বয়ে গেলো। এতো দেখছি কোভিড এর নরকখানা। এ কোথায় আমি আসলাম! এখানে তো জীবাণু থাকবে কয়েক বিলিয়ন। জীবাণুরা নিশ্চয়ই উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে।

আমার প্রোটেকশন এতো শক্তিশালী নয়। মাস্ক আর ফেসশিল্ড পরেছি মাত্র। আমি যে স্টাইলে কোভিড আক্রান্ত রোগীগুলো দেখি এরচেয়ে বেশী কিছু লাগে না আসলে। মুখোমুখি দাড়াই না। নব্বই ডিগ্রী এঙ্গেল এ কথা বলি। দূরত্বও মেইনটেইন করি। এ বাড়িতে তার কিছুই মেইনটেইন করতে পারিনি। তারা পূর্বপরিচিত। তার উপর যারা আমাকে রিসিভ করেছে তারা মাস্কবিহীন এবং আমি রোগীর সাথে দাড়িয়ে কথা বলার সময় তারা ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলছিলো। যদিও বলেছিলাম সামাজিক দূরত্ব  বজায় রেখে দাড়াতে।

কি জানি বাবা! সামাজিক দূরত্ব বলতে তারা কি বুঝে! সামাজিক দূরত্ব মানে গা ঘেষাঘেষি না করা বুঝে হয়তো। ছয়ফুট দূরত্ব যে সামাজিক দূরত্ব  এই লোকগুলোর জানতে আরো পঞ্চাশ বছর লেগে যাবে মনে হয়!

এখন অপেক্ষা করতে হবে ৫-৬ দিন। যদি লক্ষন দেখা দেয়, তবে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে।পঞ্চম দিনের মাথায় গা ব্যাথা হওয়ায় আইসোলেশনে চলে গেলাম।

পরে জেনেছি এই লোকগুলো নিয়মিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছে, কোন হোম কোয়ারেন্টাইন মানেনি। এমনকি যেদিন পজিটিভ রিপোর্ট আসে সেদিনও ব্যাংকে ছিলো। রিপোর্ট পাবার পরেও দোকানে গিয়ে বসেছে।

তার শারিরিক সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু এই একই ভাইরাস অন্যের মৃত্যুর কারন হয়। মানুষের শরীরের এই অদ্ভুত এক ব্যাপার। তাই আমরা নিরাপদ দূরত্ব ও মাস্ক পরতে বলি। আমরা তো জানিনা কার শরীর এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারবে।

কে শোনে কার কথা!

এই উপজেলায় অনেক লোক মারা গেলে তাকে নিশ্চয়ই বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আজরাইল বলবে সবাই!

আরেকদিন অন্য এক বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তারা সব নিয়মকানুন মেনে চলছে। শুধু আমার সামনে স্বামী -স্ত্রী গা ঘেষাঘেষি করে দাড়ানো, অবশ্য মাস্ক পরিহিত। মাস্কগুলো নিটওয়ার বা গেঞ্জি কাপড়ের। কোয়ালিটি আছে কিনা জানিনা। আমার সম্মুখে এই অবস্থা হলে পিছনে কিভাবে থাকে তা সহজেই অনুমেয়। আর লোকজন করবেই বা কি! ছোট ছোট বাসায় পরিবার পরিজন নিয়ে কোনরকমে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, আইসোলেশনে থাকার মতো জায়গা কোথায়! অনেক পরিবারই দুই রুমের বাসায় থাকে। এক রুমে স্বামী স্ত্রী আর অন্যরুমে গৃহকর্মী এবং বাচ্চাকাচ্চা। কমন বাথরুম একটি। এখানে আইসোলেশনের সুযোগ নেই বললেই চলে। গ্রামীণ ঘরগুলোর টয়লেট বাইরে। মোটামুটি সব পরিবারেরই একটি করে টয়লেট। আইসোলেশনের সুযোগ কোথায় এখানে?

আরেক রোগীকে দেখলাম তার দুই সন্তান তার সাথেই থাকছে। রিপোর্ট আসতে যতদিন লেগেছে তাতে সন্তানরাও সংক্রমিত হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সন্তানরা আবার আশেপাশের সব বাচ্চার সাথে খেলাধুলা করে। এবার বুঝুন কি অবস্থা হতে পারে।

সব মন্দেরই একটি ভালো দিক থাকে।এখানেও হয়তোবা আছে। সময় বলে দিবে ভালো দিক কোনটা।

এখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের কৌশলী হতে হবে। কেননা উন্নত দেশগুলো তাদের যুদ্ধ পলিসিতে পরিবর্তন আনবে এখন। তারা বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বেছে নিবে। আমরা যদি আমাদের দেশকে বায়োলজিক্যাল দিকে উন্নত না করি, তবে কয়েকবছর পরপরই এরকম ফ্লুতে আমাদের মানুষগুলোর মৃত্যু দেখতে হবে। দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে দেশকে উন্নত করার কোন বিকল্প নাই। বায়োলজিক্যাল প্রটেকশন নিজেরা তৈরী না করতে পারলে অন্য দেশগুলো কিছুদিন পরপর এভাবে আমাদেরকে মারতে থাকবে। আমরা বায়োলজিক্যাল দিক এমন পর্যায়ে নিতে হবে, যেন মাসের ব্যবধানে আমরা ভ্যাক্সিন তৈরী করতে পারি। চিকিৎসা সিস্টেমকে এমন উন্নত করতে হবে, যেন যে কোন ক্রাইসিস মূহুর্তে সব সামাল দিতে পারি।

প্রশাসনিক দাদাগিরি যতদিন থাকবে, ততদিন এই সেক্টর উন্নত হবে না, আমি হলফ করেই বলতে পারি।

৩০/০৬/২০২০

Sarif Sahriar:
Related Post