X

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স- যা জানা প্রয়োজন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২ জুলাই, ২০২০, বৃহস্পতিবার

মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ

আমাদের পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া প্রাচীনতম জীবিত জীবের মাঝে একটি। এরা সবথেকে ক্ষুদ্র প্রাণ যার মাঝে আমরা জীবন আছে বলে ধরে নেই এবং ব্যাকটেরিয়াকে সর্বত্রই পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়াই আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। আমাদের শরীরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরিমানের ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা শরীরের সিস্টেমগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সাহায্য করছে।

কিন্তু, কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যারা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তারা মানবদেহে আক্রমণ করে, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কিন্তু, বর্তমান পৃথিবীর কাছে একটা সুপারউইপন আছে, যেটা এই চরম ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মারতে সাহায্য করে, যার নাম এন্টিবায়োটিক। ভ্যাক্সিনেশনের সাথে সাথে এন্টিবায়োটিক মেডিকেল সায়েন্সে রিভোলিউশন নিয়ে এসেছে এবং একসাথে কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।

এন্টিবায়োটিক শরীরে আক্রমণ করা ব্যাকটেরিয়াকে ব্যাপক পরিমাণে ধ্বংস করতে পারে খুবই দ্রুততম সময়ে। কিছু ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক কাজ করার পরও যদি বেঁচে যায়, আমাদের ইমিউন সিস্টেম তখন সহজেই বাকিদেরকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়।

এন্টিবায়োটিক যেভাবে ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করেঃ

ধরে নিলাম, ব্যাকটেরিয়া একটি জটিল যন্ত্র যার ভেতরে দুর্বোধ্য অনেক জিনিস লুকানো আছে। জটিল যন্ত্রপাতি গুলো ব্যাকটেরিয়াকে বেঁচে থাকতে এবং একটিভ রাখতে সাহায্য করে থাকে। এন্টিবায়োটিক এই জটিল কাঠামোটাকে আক্রমণ করে ভেঙে ফেলে। যেমন-

  • ব্যাকটেরিয়ার মেটাবলিজমের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে।
  • কিছু এন্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ কে আক্রমন করে, এতে নতুন কোন ডিএনএ এর কপি তৈরি হয়না, ব্যাকটেরিয়া মারা যায় এবং পুনরায় বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা।
  • কিছু এন্টিবায়োটিক আবার ব্যাকটেরিয়ার বাহিরের আবরনকে নষ্ট করে ফেলে, এতে ভেতরের জিনিসপত্র সব বাহিরে বের হয়ে আসে ও ব্যাকটেরিয়া দ্রুত মারা যায়।

এসব কিছুই করা হয় শরীরের প্রয়োজনীয় কোষের কোন ক্ষতিসাধন না করেই।

কিন্তু, পৃথিবীর ইভোলিউশন বর্তমানে এই ব্যাপারকেই জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। প্রযুক্তি এগিয়েছে, মানুষের কাজ করার সক্ষমতা বেড়েছে এবং দুনিয়া সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়াও আধুনিক যুগে বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদেরকে এন্টিবায়োটিকের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নতুন নতুন রূপে সাজাচ্ছে। এতে আমাদের শরীরে প্রয়োগকারী এন্টিবায়োটিক আর আগের মতো কাজ করতে পারছেন। কারণ –

  • এন্টিবায়োটিক কে তার কাজের আগেই ব্যাঘাত ঘটানো বা ব্যাকটেরিয়ার মলেকিউলার চেইঞ্জিং এর মাধ্যমে। এতে এন্টিবায়োটিক সেই বুদ্ধিমান ব্যাকটেরিয়ার জন্য অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
  • এন্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে গিয়ে কাজ করার আগেই তাকে ব্যাকটেরিয়া তার নিজস্ব পাম্পের মাধ্যমে শক্তি খাটিয়ে বের করে দেয়। তাই ব্যাকটেরিয়ার কোন ক্ষতিই হচ্ছেনা।

অল্প সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া হলে, আমাদের ইমিউন সিস্টেম তাদেরকে মেরে ফেলতে পারে সহজে। কিন্তু, আমাদের শরীরের সিস্টেম যদি তাদেরকে মারতে না পারে, বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলো আরো শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে শরীরের ভেতরেই।

ব্যাকটেরিয়া যেভাবে এতো বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠেঃ

  • প্রথমত, ব্যাকটেরিয়ার দুই ধরনের ডিএনএ থাকে। ক্রোমোজম এবং প্লাসমিড। প্লাসমিড হলো ব্যাকটেরিয়ার ভাসমান একটা ডিএনএ এর ছোট্ট টুকরো। ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মাঝে প্লাসমিডের আদান-প্রদান করতে পারে, এতে তাদের এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই কোন একটা ব্যাকটেরিয়া যদি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, সে তার পাশের ব্যাকটেরিয়া গুলোকে প্লাসমিড শেয়ারের মাধ্যমে তাকেও বুদ্ধিমান করে তুলতে পারে।
  • দ্বিতীয়ত, ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবিত ব্যাকটেরিয়া মৃত ব্যাকটেরিয়ার কাছ থেকে ডিএনএ নিয়ে নিতে পারে। এই ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়াটি দুটি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমেও হতে পারে, এতে একটি ব্যাকটেরিয়াই বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জাতের ব্যাকটেরিয়া থেকে বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে ফেলে। ফলে, এক জাতের ব্যাকটেরিয়া কয়েকধরণের এন্টিবায়োটিক কে চিনে ফেলে এবং তাদেরকে অকেজো করে দিতে সক্ষম হয়। একটা ব্যাকটেরিয়াকে মারতেই তখন অনেক এন্টিবায়োটিক লেগে যায়।

পৃথিবীতে বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা মানুষের তৈরি বেশির ভাগ এন্টিবায়োটিক কে পরোয়া করেনা, এদেরকে আমরা “সুপারবাগ” বলি।

বর্তমান যুগ প্রি-এন্টিবায়োটিক এর যুগকে পেছনে ফেলে চলে এসেছে, যে যুগে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণেই অনেক মানুষ মারা যেতো। আমরা এন্টিবায়োটিক কে মেডিকেল সায়েন্সের একটা মারাত্মক পরিবর্তন হিসেবেই দেখি, এটা আমাদের জন্য জীবন বাঁচানোর নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

কিন্তু, এই এন্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারে দেখা দিতে পারে মারাত্মক অসুবিধা। উন্নত অনেক দেশেই এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারকে জনগণের কাছে সীমিত আকারে ধরে রাখা হয়েছে। অপরদিকে অনেক দেশেই মানুষ না বুঝে এন্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলছেন, এটাকে খুব সহজেই প্রেসস্ক্রাইবও করা হচ্ছে। এন্টিবায়োটিক কে অন্য ধরনের ওষুধ কাজ না করার ফলে ব্যাকটেরিয়া দমনে শেষ হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করা উচিত।

সবথেকে বড় ঝুঁকির ব্যাপার হল-

ব্রয়লার মুরগী কিংবা অনেক পশুর ফার্মেই গবাদিপশুকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। মাংসকে সহজলভ্য করার জন্য মানুষেরা গবাদিপশুকে খাওয়াচ্ছে এন্টিবায়োটিক। পশুপাখিদের অপরিষ্কার স্থানে থাকার কারণে সহজেই রোগ জীবাণু তাদের শরীরে ঢুকে যায়। তাই, গবাদি পশুকে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, যাতে সেটা বেশি বেশি ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারে, এতে পশুগুলো সুস্থ থাকে। আমরা সেই পশুর মাংস খাচ্ছি, এতে প্রচুর পরিমাণের রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের মাঝেও প্রবেশ করতে পারছে।

আমাদের শরীরের বেড়ে যাওয়া রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া গুলোর জন্য আমরা বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছি। কিন্তু, দিন দিন ব্যাকটেরিয়া শক্তিশালী হয়েই চলেছে। কিছু কিছু এমন শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক আছে, যা এই সুপারবাগ গুলোকে মেরে ফেলে, তবে তাদেরকে খুব সাবধানতার সাথে ব্যবহার করা হয়।

২০১৫ সালে চিনা গণমাধ্যম প্রকাশ করে, সবথেকে শক্তিশালী একটি এন্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তারা খুঁজে পেয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিছু রোগীকে এই ওষুধটা দেওয়া হয়। এই শেষ একটা সম্বলকেও ব্যাকটেরিয়া কাবু করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে যদি শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক গুলোর বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ারা জিতে যায়, তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু ব্যাকটেরিয়ার কারণে সাধারণ জ্বর ঠান্ডায় কিংবা ব্লাডার ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। কোন ওষুধই আর বাকি থাকবেনা পৃথিবীতে কাজ করার।

আমাদেরকে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের মানব শরীরে কোন কিছুর রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়না, রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয় শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াতে।

যে ফ্যাক্টরগুলো এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সকে দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিচ্ছেঃ

  • এন্টিবায়োটিক যদি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে ব্যবহার না করে ভুলবশত ভাইরাল কিংবা ফাংগাল ইনফেকশনে ব্যাবহার করা হয়। কিংবা দূর্বল কোন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন যেটা শরীর নিজ থেকেই সারিয়ে নিতে সক্ষম।
  • ভাইরাল জ্বর ঠান্ডার কারণে ফার্মেসি থেকে ধুম করে এন্টিবায়োটিক এনে খাওয়া এবং রোগীর কোর্স শেষ না করা। ভাইরাল জ্বরে এন্টিবায়োটিক কাজ করবেনা, এটা শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াকেই মারতে পারে।
  • গবাদিপশুকে ইচ্ছেমতো এন্টিবায়োটিক খাইয়ে ফেলা, যেটা পরবর্তীতে মানবদেহে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটাতে পারে।

যতোটা দ্রুততার সাথে ব্যাকটেরিয়া বুদ্ধিমান হয়ে রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে এন্টিবায়োটিকের প্রতি, ততোটা দ্রুত কিন্তু নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছেনা! তাই আমাদের সচেতনতা এবং এ বিষয়ে শিক্ষাই পারে এন্টিবায়োটিকের সঠিক এবং পরিমিত ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে এবং সুস্থ জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে স্থান দিতে।

Sayeda Alam:
Related Post