X

ইউরোপে উচ্চশিক্ষায় ‘ইরাসমুস মুন্ডুস’ স্কলারশিপ : সুযোগ ও সম্ভাবনা

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থা প্রতিবছরই মেধাবী শিক্ষার্থীদের অজস্র স্কলারশিপ দিচ্ছে। ইউরোপে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ ইউরোপিয়ান কমিশন প্রদত্ত ‘ইরাসমুস মুন্ডুস’ স্কলারশিপ।
উচ্চতর গবেষণা, নতুন নতুন দেশ ও সংস্কৃতি জানা এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি এই স্কলারশিপের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে
*মাসিক স্কলারশিপের পরিমাণ,
*সম্পূর্ণ ভ্রমণ ভাতা,
*স্বাস্থ্যবীমা ও গবেষণা সম্পর্কিত সকল খরচ বহন।
*তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে সকল ধরনের টিউশন ফি, লাইব্রেরি ফি, পরিক্ষা ফি, গবেষণা সংক্রান্ত ফি সহ বিভিন্ন ধরনের কনফারেন্স/সেমিনার/ সামার স্কুল/উইন্টার স্কুল প্রভৃতি সকল কিছুই থাকছে একেবারে ফ্রি।
এমনকি দেশভেদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে সম্পূর্ণ বিনা খরচে খাবারের সুবিধাসহ শহরভেদে পাবলিক পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অর্ধেক খরচে চলাচলের সুবিধা; ইউরোপের বিমান চলাচলেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রমোশন ব্যবস্থা। একসময় শুধুমাত্র মাস্টার্স করার সুযোগ থাকলেও এখন ব্যাচেলর ও পিএইচডি করার জন্যও রয়েছে দারুণ সব সুযোগ।
এছাড়া প্রতিটি মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে একাধিক দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি থাকায় এই স্কলারশিপের অধীনে শিক্ষার্থী তার কোর্স চলাকালে নূন্যতম দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাবেন। ৩০০ এর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের ২৮৫ টি প্রোগ্রামে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী ও ১৫০০ জনের মতো পিএইচডি শিক্ষার্থী প্রতি বছর ‘ ইরাসমুস মুন্ডুস’ স্কলারশিপের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ তথা- বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ইদানীং প্রতি বছর এই স্কলারশিপের অধীনে বাংলাদেশ থেকে স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন। ৬ মাস, ১০ মাস, এক বছর/দুই বছরের কোর্স কিংবা পিএইচডি ডিগ্রিতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে নতুন নতুন সুযোগ তৈরিসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার কিংবা স্বনামধন্য কোম্পানিতে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা।
ইরাসমুস মুন্ডুস’ স্কলারশিপে আবেদন সম্পর্কিত তথ্য :
ইরাসমুস স্কলারশিপের বেশির ভাগ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে আবেদন করতে হয় অনলাইনে। আবেদন করার জন্য কোনো প্রকার ফি দিতে হয় না। সকল প্রকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে নির্ধারিত স্থানে আপলোড করতে হয় অথবা ইমেইলে পাঠাতে হয়। প্রত্যেকটি প্রোগ্রামের নিজস্ব ওয়েবসাইটে কারা কারা আবেদন করতে পারবেন সেই সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য, আবেদনকারীর ন্যূনতম যোগ্যতা, আবেদন করার সময়সূচি, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বিশদ বর্ণনা দেওয়া থাকে।
সাধারণত মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ডিগ্রি সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট, জীবনবৃত্তান্ত, ইংরেজি ভাষাশিক্ষার স্কোর, শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত পড়ালেখা সম্পর্কিত মোটিভেশন লেটার ও শিক্ষার্থী সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখেন এমন দুজন যোগ্য ব্যক্তির সুপারিশপত্র (রিকমেন্ডেশন লেটার) দিয়ে আবেদন করতে হয়। দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত শিক্ষার্থীর গবেষণাপত্র (যদি থাকে), যেই প্রোগ্রামে পড়ালেখা করতে আগ্রহী সেই প্রোগ্রামের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা কিংবা তদসংশ্লিষ্ট সকল ধরনের কো-কারিকুলার কার্যক্রম আবেদন প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজস্ব প্রস্তাবিত গবেষণা কাজ জমা দিতে হয়। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ তিনটি প্রোগ্রামে আবেদন করতে পারবেন। ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের আবেদন করা যাবে প্রোগ্রাম অনুসারে এ বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস পর্যন্ত।
কিছু পরামর্শ :
১। যেহেতু ৩টির অধিক প্রোগ্রামে আবেদন করার সুযোগ নেই, সেহেতু গতানুগতিকভাবে আবেদন না করে প্রথমেই নিজের পড়ালেখা, গবেষণা অভিজ্ঞতা ও গবেষণা আগ্রহের সাথে মিল রেখে সবচেয়ে ভাল প্রোগ্রামগুলো খুঁজে আলাদা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া দরকার। এতে করে আবেদন সম্পর্কিত নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সময় নিয়ে ভাল ভাবে সম্পন্ন করে একটি পূর্ণাঙ্গ আবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে।
ইরাসমুস মুন্ডুস মাস্টার্স কোর্সসমূহ :
http://eacea.ec.europa.eu/erasmus_mundus/results_compendia/selected_projects_action_1_master_courses_en.php
ইরাসমুস মুন্ডুস পিএইচডি কোর্সসমূহ:
http://eacea.ec.europa.eu/erasmus_mundus/results_compendia/selected_projects_action_1_joint_doctorates_en.php
২। বাইরে উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার স্কোর (আয়েল্টস/ টোফেল/জিআরই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবেদনকারীর অর্জনকৃত ইংরেজি ভাষা শিক্ষার স্কোর অবশ্যই আবেদন করার সময়সীমার মাঝে থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, ইরাসমুস স্কলারশিপের কিছু কিছু প্রোগ্রামে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার স্কোর জমা না দিয়েও আবেদন করা যায়। এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি তার স্নাতক পড়ালেখা সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে করে থাকেন, অর্থাৎ মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন যদি ইংরেজি হয়ে থাকে, সেটার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি সনদ সংগ্রহ করে জমা দিতে হয়। আবেদন করার আগে নিজের পছন্দসই প্রোগ্রামের ওয়েবসাইট হতে কিংবা প্রোগ্রাম কো-অরডিনেটরকে মেইল করার মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হওয়া যাবে এই প্রোগ্রামে মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন সনদ দিয়ে আপনি আবেদন করতে পারবেন কিনা!
৩। মোটিভেশন লেটার লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা, কেন তিনি এই প্রোগ্রামে আবেদন করেছেন সংক্ষিপ্ত কথায় তার আবেদনের তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এই প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ কিংবা সমাজে কিভাবে উপকৃত হবে, নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রভৃতি নিখুঁতভাবে সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ১-২ পাতার মধ্যে লিখে জমা দিতে হয়।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইন্টারনেট থেকে কিংবা ইতোপূর্বে উচ্চ শিক্ষায় দেশের বাহিরে পাড়ি দিয়েছেন এমন মানুষদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আপনার মোটিভেশন লেটার স্কলারশিপ প্রাপ্তিতে আপনার যোগ্যতাকে অনেকাংশেই বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে!
৪। ইরাসমুস স্কলারশিপের আবেদনে অধিকাংশ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেই জীবন বৃত্তান্ত (Curriculum Vitae) জমা দিতে হয়। ইউরোপের ক্ষেত্রে জীবন বৃত্তান্ত তৈরিতে Europass ফরম্যাট ব্যবহার করা উত্তম।http://europass.cedefop.europa.eu/ – এই লিংক থেকে Europass ফরম্যাট সম্পর্কিত বিস্তারিত জানা যাবে।
৫। প্রত্যেক প্রোগ্রামেই রিকমেন্ডেশন লেটার জমাদানের বাধ্যবাধকতা থাকে। শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সময় ধরে ভালভাবে চিনেন এমন ২ জন যোগ্য ব্যক্তি থেকেই রিকমেন্ডেশন লেটার নেওয়া উত্তম। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, স্নাতক/স্নাতকোত্তর গবেষণা কাজের সুপারভাইজার, কিংবা আপনার কর্মক্ষেত্র যদি আবেদনের সাথে সম্পর্কিত হয় তবে সেই প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে থেকেই রিকমেন্ডেশন লেটার নেওয়া ভাল।
৬। সময়কে অনুধাবন করতে হবে। কখনোই ডেডলাইনের তারিখে এপ্লিকেশন করার জন্য বসে থাকা ঠিক নয়। সামান্য কারণে অনেক সময় শেষ মুহূর্তে এসে অনেক কিছুই হারাতে হতে পারে কিংবা ভুল হয়ে যেতে পারে! তাছাড়া ইন্টারনেট সম্পর্কিত ঝামেলাতো থাকছেই।
শুধুমাত্র সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের যথাযথ প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে ইউরোপে উচ্চশিক্ষায় ইরাসমুস মুন্ডুস স্কলারশিপই হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য! আপনি যদি সত্যিকারের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, গবেষক, ভ্রমণবিলাসী কিংবা পৃথিবী দেখার স্বপ্ন লালনকারীদের একজন হয়ে থাকেন, তাহলে আর দেরি কেন? অন্তত একবার ঘুরে আসুন ইরাসমুস মুন্ডুস স্কলারশিপের ওয়েবসাইটে
নিজের অজান্তেই দেখবেন, আপনিই এই স্কলারশিপ পাওয়ার উপযুক্ত। একটু সাহস আর একটি সিদ্ধান্ত, আপনাকে করবে আপনার স্বপ্নের সমান বড়।
লেখক:
মো. আশিকুর রহমান
কান্ট্রি এম্বাসেডর অব বাংলাদেশ, ইরাসমুস মুন্ডুস এসোসিয়েশন (EMA)
শিক্ষার্থীইউনিভার্সিটি অব রোম লা স্যাপিয়েঞ্জা, ইতালি।
মেইল: engr.ashik.bd@gmail.com
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
জাহিদুল হাসান রাতুল
মুগদা মেডিকেল কলেজ,ঢাকা।
সেশন:২০১৬১৭
ফয়সাল আবদুল্লাহ:
Related Post