X

“আব্বুর কোভিড-১৯ জয়ের গল্প”- দ্বিতীয় পর্ব

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৭ জুন ২০২০, রবিবার

সায়লা আক্তার রিমি
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (ডেন্টাল ইউনিট)
সেশনঃ ২০১৬-১৭

১৩ মে ২০২০, ১৯ তম রোজার সেহেরী করতে উঠবো। এর মধ্যেই ইমন ফোন দিয়ে জানায় আব্বুর কোভিড-১৯ পজিটিভ আসছে। মুহূর্তের মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। উঠে মুখে পানি দিলাম। আম্মুদের কিভাবে বলবো কিছুই মাথায় আসে না তখন। এর মধ্যে ডা. ফয়সাল ভাই আব্বুকে কল দিয়ে জানালো। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কাকে কল দিবো! কার সাথে কথা বলবো! ইমন কল দিলো। বললো জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে সকালে। ওরা বলবে কি করতে হবে। আমি ডা. ইফতেখার ভাইকে কল দিলাম এবং সব বললাম। ভাইয়া সব শুনে সুন্দর করে বুঝায় বলেন কি করতে হবে।

সে রাতে আর কেউ ঠিকমত সেহেরি করতে পারিনাই। আযানের আগে পানিও খাওয়া হয় নাই কারো। নামাজে বসে কান্না করছে সবাই।

এরপর আর চোখে ঘুম নাই কারো। কিছুই মাথায় আসে না তখন। আব্বুকে কোথায় নিবো! না বাসায় রাখবো! বাসায় রাখলে আমরা কি সব হ্যান্ডেল করতে পারবো! আম্মুরও এজমা আছে! আম্মুকে নিয়ে কিভাবে! এদিকে আমরা সবাই একঘরে ছিলাম। আমরা কি টেস্ট করবো! করলে কখন! টেস্ট করতেও কত কষ্ট আর ঝামেলা! আম্মুকে সেখানে নিয়ে যাওয়া কি সেইফ হবে! তার ওপর আমাদের কারো কোনো সিম্পটম এরাইজ করে নাই তখনো! এতসব ভাবতে ভাবতে সকাল। সকাল হতেই সবকিছু লিখে মেসেজ করি আমাদের ডা। মঞ্জুর ই মাহমুদ স্যারকে আর ডা. আরিফ আশিক ভাইকে। এরপর ৮ টার দিকে কল দিলাম ডা। মইনুল স্যারকে। স্যাররা সবাই আমার কথা শুনেন, এবং সাহস দেন। টেস্ট করে ফেলতে বলেন, বাসায় স্ট্রিক্টলি কোয়ারেন্টিন মেইনটেইন করতে বলেন আর একজন মেডিসিন স্পেশালিষ্ট স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি ওই মূহুর্তে যার কাছে ভরসা পাবো ভাবছি তার সাথেই যোগাযোগ করি আর তারাও আমাকে সবরকম সাজেশন দিয়ে সাহায্য করেন।

স্যার আপনারা হয়ত এই লিখাটা দেখবেন না। তবে আমি সবসময় আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।

স্যারদের সাথে কথা বলার পর, আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলি। এখন কি করবো? আব্বু বাসায় থেকে চিকিৎসা নিবে কি না? আম্মু সব মেইনটেইন করে চলতে পারবে কি না? আম্মু আব্বুকে হাসপাতালে পাঠাতে নারাজ আর আব্বুও বাসায় থাকবে। তারওপর আব্বুর আল্লাহর রহমতে মাইল্ড সিম্পটমস ছিলো, তাই সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আব্বু কে বাসায় রেখে ট্রিটমেন্ট করাবো আর এরজন্য কোন স্যারের সাথে কথা বলবো সেটা খুঁজতে লাগলাম।

শেষে জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ আব্দুর রব স্যারের সাথে ফোনে কথা বলি। স্যারকে সব জানাই। বলি বাসায় রেখে ট্রিটমেন্ট করতে চাই। আব্বুও স্যারের সাথে কথা বলে নিজের ফোন থেকে, সিম্পটমগুলো জানায়। স্যার আব্বুকে প্রেসক্রিপশন মেসেজ করে দেন। আর আমরা টেস্ট করবো কি না জানতে চাইলে স্যার বলেন ১৪দিন কোয়ারেন্টিনে থেকে কোনো প্রকার সিম্পটম শো করে কি না খেয়াল রাখতে। সিম্পটম এরাইজ করা ছাড়া টেস্ট করতে না যেতে, এতে ফলস নেগেটিভ রিপোর্টের সম্ভাবনা থাকে আর হাসপাতাল থেকেই ইনফেক্টেড হওয়ার একটা চান্স থাকে সাথে ভোগান্তি তো আছেই।

স্যারের কথা মত আমরা আব্বুর সেল্ফ আইসোলেশন শুরু করলাম পুরোদমে। সাথে আমরাও কোয়ারেন্টিনে চলে গেলাম।

এদিকে বাসা লকডাউন করবে সে চিন্তায় পরে গেলো আম্মু। ঘরের বাজার করা লাগবে মিনিমাম ১৪ দিনের জন্য। পরিচিত দোকানে কল দিলো আম্মু। যা যা লাগবে সব লিখে পাঠানো হলো। সাথে ওষুধ সহ আর যা যা দরকারি জিনিসপত্র আছে সব কিছুর লিস্ট করে মেসেজে রবিন ভাইয়াকে (আমার দুলাভাই) দেওয়া হলো। ভাইয়া সবকিছু কিনে বাসার সামনে রেখে যান।

এই দুর্দিনে আমাদের সব কাজে সবসময় পাশে ছিলো আমার আপু আর দুলাভাই। যখন যা লাগবে সবকিছু এক কথায় কিনে বাসার সামনে রেখে গেছে। দুইবার, চারবার অথবা পাঁচবার, যতবার বলা হয়েছে। ভাইয়া আর আপু ছিলো দেখে আমাদের কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করা লাগে নাই।

আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের আন্টিও অনেক হেল্প করছেন। সবসময় খবর নিয়েছেন। নিজের বাজার আনলে আমাদের কিছু প্রয়োজন হলে সেটা নিয়ে এসে দরজার সামনে রেখে গেছেন। বিল্ডিংয়ের বাড়িওয়ালাসহ কম বেশি সবার কাছ থেকেই সাপোর্ট পাই। সবাই সাহস দেয়,ফোন দিয়ে নিয়মিত খোঁজ নিতে থাকে। সবার কাছে আমার পরিবার কৃতজ্ঞ থাকবে।

প্রয়োজনীয় সব কিনে বাসায় রাখা হলো। আমরা সবাই বাসায় মাস্ক পরতাম। শুধু মাত্র নিজের রুমে থাকলে তখন মাস্ক পরতাম না। ছোট ভাইকে সামনের রুম থেকে মাঝের রুমে নিয়ে আসা হইলো। এবার শুরু হইলো আব্বুর কঠোর আইসোলেশনে থাকার পালা। সাথে আমাদের হোম কোয়ারেন্টিন।

এতদিন আব্বুর প্লেট মগ আমি ধুয়ে আলাদা করে রাখতাম। এখন থেকে সিদ্ধান্ত হইলো আব্বুর জিনিসপত্র, রুম, কাপড় সব আব্বুই পরিষ্কার করবে। আমরা কেউই সে রুমে যাবো না আর সম্পূর্ণ নন-টাচ টেকনিকে আব্বুকে খাবার দাবার দেয়া হবে।

এবার ওষুধ হিসাবে ডা. রব স্যারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আব্বুকে দিলাম কিছু ঔষধ, সাথে কিছু ট্যাবলেট, স্যালাইন, সিভিট এবং মেডিসাইজার (ব্রিদিং এক্সারসাইজ করার জন্য, কিন্তু এইটা তার জন্য কঠিন ছিল বিধায় আমি বললাম ম্যানুয়াল ব্রিদিং এক্সারসাইজই করতে। সাথে দিলাম ব্লিচিং পাউডার, স্প্রে বোতল,ডেটল,ডিটারজেন্ট পাউডার, ডিশ ক্লিনার,ময়লা ফেলার জন্য পলিথিন আর ঢাকনাসহ ওয়েস্ট জার ইত্যাদি।

সাথে আব্বুকে বিশেষ কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া হলো। যেমনঃ

১. দিনে তিনবার শরীরের তাপমাত্রা মেপে রিডিং আমাকে জানানো আর আমি নোট করতে থাকি সেটা।

২. দিনে ৩-৪ বার ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে। ব্রিদিং এক্সারসাইজঃ আলো বাতাস পূর্ণ জায়গা যেমন জানালার পাশে চেয়ারে বসতে হবে সোজা হয়ে। এরপর ধীরে ধীরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া,যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় ডিপ ইনস্পিরেশন বলে। এরপর ৩-৫ সেকেন্ড নিশ্বাস আটকে রেখে ধীরে ধীরে নিশ্বাসটা ছেড়ে দেওয়া। এভাবে ৫-১০ বার করার পর একটা কাশি দেওয়া আর খেয়াল রাখা আশেপাশে যাতে কেউ না থাকে আর হাতে টিস্যু থাকে। (ইউটিউব এ এই বিষয়ে অনেক স্পেশালিষ্টদের ভিডিও আছে)

৩. প্রতিবার শোয়ার সময় অন্তত ১০-১৫মিনিট উপুড় হয়ে শোয়া (প্রণ পজিশন), বাম কাত হয়ে শোয়া (লেফট ল্যাটারাল), ডান কাত হয়ে শোয়া (রাইট ল্যাটারাল) আর ঘুমানোর সময় উঁচু বালিশ ব্যবহার করা।

৪. সবসময় শরীরের যেকোনো রকম পরিবর্তন, যেকোনো রকম সিম্পটম খেয়ালে রাখা আর আমাকে টাইম টু টাইম সব জানানো। কোনোরকম শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা হয় কি না তা খেয়াল রাখা। নিশ্বাস নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা খেয়াল রাখা।

৫. আধ ঘন্টা পরপর গরম পানি খাওয়া। ২ টা কারণে।এক, যাতে ডিহাইড্রেশনে না যায় কোনোভাবে। দুই, গলা ভেজা থাকলে গলায় খুশখুশ কম হয়, কাশিটা কমে আর আরাম লাগে।

আব্বুকে ২ ঘন্টা পরপর কম কম পরিমাণে খাবার দিতে থাকি। মাল্টা, স্যুপ, ডিম, দুধ, মাংস, বিভিন্নরকম তরি-তরকারি, ভাত, সুজি, বিভিন্ন প্রকার ফল এসব দেওয়া হয়।
যেহেতু জ্বরের কারণে মুখে একদম রুচি থাকে না, তাই এসময় একবারে বেশি খাবার দেয়া একদম উচিত না। সে জায়গায় কম কম পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে বারবার।

ডাইনিং টেবিল সরানো হলো, সে জায়গায় কৌশিককে আলাদা পার্টিশন দিয়ে ছোট রুম করে দেয়া হইলো। (ওর ভাষ্যমতে সেটা তাবু ছিলো!) আম্মু আর কৌশিকেরও প্লেট-মগ, ফ্লাস্ক, পানির বোতল, ডিসইনফেক্টন্ট স্প্রে, হ্যান্ডরাব, মাস্ক, গ্লাভস, ওয়েস্টবিন সব আলাদা করে রাখা হলো। যার যারটা সে ইউজ করবে। নিজে পরিষ্কার করবে। কৌশিককে দেয়া হলো ডাইনিংয়ের বেসিনটা আর আম্মু নিলো কমন বাথের বেসিনটা ব্যবহারের জন্য। যেহেতু দুইজনের একটা বাথ ব্যবহার করা লাগবে সেজন্য দুইজনকে আলাদা মগ দেয়া হলো আর প্রতিবার বাথরুমে ঢোকা আর বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় যাতে যেসব জায়গায় টাচ করা লাগছে সেগুলো ডিসইনফেক্ট করে সেটা বলে দেয়া হলো। তারা সেটাই করতে থাকে। বাসায় সবাই স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে হাটা শুরু করি। নিয়মিত হ্যান্ড স্যানিটাইজ করতে থাকি,অভ্যাসে নিয়ে আসি।

এতদিন আমি মাস্ক পরে আম্মুর রুম,পাকঘর পরিষ্কার করতাম এখন থেকে সেটাও বন্ধ করা হইলো। আম্মুর রুম আর পাকঘরে শুধু আম্মু যেতে পারবে,আমার রুম আর ড্রয়িং রুম যেটার পাশে আব্বুর রুম ছিলো সেখানে শুধু আমি যাবো আর কৌশিক শুধু ওর মাঝের রুমে থাকবে। খাবার আমরা ননটাচ টেকনিকে নিতে শুরু করলাম। আব্বুর সাথে কথা বলতে হলে ফোনে কথা বলবে অথবা ভিডিও কলে। ফেইসটুফেইস কথা শুধু আমি বলতাম আব্বুর সাথে তাও মাস্ক পরে ২মিটার দূরে থেকে। এতদিন আম্মু সামনের রুমের শেষ মাথায় বসে আব্বুকে দেখতে পারতো কথা বলতে পারতো, এবার সেটাও বন্ধ করে দিলাম। খুব অমানবিক মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে কি, এটাই একমাত্র উপায় ছিলো সবাইকে একসাথে ভালো রাখার।

আব্বুর সাথে সাথে আমরাও জিংক ট্যাবলেট, সিভিট নেয়া শুরু করলাম। গরম পানি খাওয়া, লেবু আদা চা খাওয়া, গরম পানির গার্গল করা,ভাপ নেয়া এসব আমরাও শুরু করি। ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার, দুধ, ডিম, মাংস, বেশি বেশি পানি খাওয়া এসব চলতে থাকে আমাদের ক্ষেত্রেও। (উল্লেখ্য, পরের ১২টা রোজা আমরা কেউ রাখতে পারি নি। আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিয়ত করছিলাম সবাই সুস্থ থাকলে একসাথে সব ক্বাযা রোজাগুলো রাখবো)

এভাবে দিন যেতে থাকে। আর আমি সবসময়ই ডা. রব স্যার, ইফতেখার ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ রাখি। যেকোনো সমস্যায় ওনাদের কল দিতাম। ওনারা সলিউশন দিতেন, সাহায্য করতেন। আব্বুকে বাসায় রেখে ট্রিটমেন্ট করার ব্যাপারে সাপোর্ট করেন আর শুধু খেয়াল রাখতে বলেন শ্বাসকষ্টের ব্যাপারটা৷ ১৪ দিন পার হলে সবঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন।

এরমধ্যে সিনথিয়ার মাধ্যমে চমেকের ডা. আনোয়ার সায়েদ স্যারের সাথে যোগাযোগ করি। আমি এই ২-৩ সপ্তাহে অনেকজনের সাথে কথা বলতে থাকি। কারণ সব ডাক্তার এখন অনেক ব্যস্ত। সবাইকে সব মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব হয় না।

ডা. আনোয়ার সায়েদ স্যার অসম্ভব সাপোর্টিভ একজন মানুষ। এইরকম একটা সিচুয়েশনে যখন সবাই দৌঁড়ঝাপের মধ্যে আছে,স্যারকে যতবার কল দিয়েছি অনেক সময় নিয়ে আমার সব কথা শুনেছেন। সবরকম নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। কখনো কল রিসিভ করতে না পারলে নিজে কল ব্যাক করছেন, আব্বু আম্মুর খোঁজ নিয়েছেন। স্যারের জন্য আমি অন্তর থেকে দোয়া করি সবসময়। আমাদের ডা. মইনুল স্যারও ফোন দিয়ে আব্বুর খোঁজ নেন। এত এত স্যার, সিনিয়রদের কাছ থেকে যখন এভাবে সাপোর্ট পাই মনে হলো মেডিকেলে ভর্তি হওয়াটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছিলো।

অনেকদিন ধরে পরিচিত মানুষরা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন৷ যখন যেভাবে পারছি সবাইকে বুঝায় বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেক কে পারতিছি না। এজন্য এভাবে লিখা। সবাই যাতে সাবধানে থাকে, মোটামুটি একটা নলেজ নিয়ে রাখে।

Ruhana Auroni:
Related Post