X

অন্তরালের গল্প || পর্ব-৪; শুভ জন্মদিন “ওয়ান্ডার গার্লস”

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৩০ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা. তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী
কমান্ড্যান্ট, সিএমএইচ, ঢাকা

গত ১৬ জুলাই ছিলো রাবেয়া-রোকেয়ার চতুর্থ জন্মদিন। করোনা ক্লান্ত সময়ে খুব সাদামাটা ভাবে পালন করা হলো তাদের জন্মদিন। কিন্তু যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তারা বড় হচ্ছে, তা ক্ষণিক হলেও বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে করোনার কারণে। গতমাসেই তাদের আরেকটা সার্জারী হবার কথা ছিলো আমাদের হাসপাতালে, কিন্তু হয়নি।

পাবনার চাটমোহরে রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা বেগম দম্পত্তির ঘরে বিরল দুই মানব সন্তান জন্ম নেয়, ১৬ জুলাই ২০১৬ সালে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাদেরকে বলা হয় “Craniopagus twins”। কনজয়েন্ট টুইন অথবা মাথা জোড়া লাগানো জমজ বাচ্চা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং বিকলতা। ২.৫ মিলিয়ন জীবিত বাচ্চার মধ্যে মাত্র একটি মাথা জোড়া লাগানো বাচ্চা জন্ম নেয়। ৪০% মাথা জোড়া লাগানো শিশু মৃত অবস্থায় জন্ম নেয় এবং আরো এক তৃতীয়াংশ শিশু ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। মোটামুটি শতকরা ২৫ ভাগ শিশু বেঁচে থাকে জমজ মাথা নিয়ে, যাদের শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে আলাদা করার সুযোগ থাকে। এটি বিরল অপারেশন, সারা বিশ্বেই খুব অল্প পরিমাণে হয়েছে। সাফল্যের হারও খুব বেশী নয়।

পাবনার একটি ক্লিনিকে শিক্ষক দম্পতির ঘরে জন্ম নেয়া এই দুই শিশু এবং তার পিতামাতাকে জন্মের পরই পেতে হয়েছিল সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্নতার পরিচয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তারা পত্র লিখেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ঢাকার একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে তাদের নিয়ে আসা হলে হাংগেরীর ‘একশন ফর ডিফেন্সলেস পিপল’ এর ডা. গ্রেগ পাটাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই জটিল শল্য চিকিৎসা সম্ভব বলে জানান।

এই শল্য চিকিৎসাটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে ঢাকার একটি সরকারি স্বনামধন্য হাসপাতালে এবং ৪ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে হাংগেরীতে ৪৮ টি ছোট বড় সার্জারি সম্পন্ন হবার পর ২২ জুলাই ২০১৯ সালে অস্ত্রপচারের সবচাইতে জটিল অংশ ‘জমজ মাথা’ আলাদাকরনের কাজটি সম্পন্নের জন্য তারা আমাদের হাসপাতালে আসে। আমাদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ সবরকম সহায়তার জন্য আমাদের নির্দেশনা দেন।

০১ আগস্ট ২০১৯ সালে, আমাদের হাসপাতালে পৃথকীকরণের জটিল অপারেশনটি শুরু হয়ে ৩৩ ঘণ্টা ব্যাপী চলে এবং ০২ আগস্ট শেষ হয়। হাংগেরীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে আমাদের হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ এবং সাথে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের প্রায় শ’খানেক চিকিৎসক এতে অংশ নেন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে।

যে অন্ধকার অমানিশার মধ্যে রফিকুল ও তাসলিমা দম্পতি পড়েছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় হাংগেরীয় টিম এর সহায়তায় তারা আলোর দিশা দেখতে পেরেছেন।

কনজয়েন্ট টুইনদের মধ্যে বিশেষতঃ মাথা জোড়া লাগানো বাচ্চাদের আলাদা করার শল্যচিকিৎসা বিগত ১০০ বছর ধরেই বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিগনিত হয়েছে। এধরণের চিকিৎসা পরিকল্পনা যেমন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ, জটিল, তেমনি প্রয়োজন হয় বিশাল এক কর্মযজ্ঞের।

সমস্ত শল্যচিকিৎসার ফাইনাল অংশটি যেন একটি মিলিটারি “মেজর অপারেশন অব ওয়ার” এর মত আমাদের হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছিল। দফায় দফায় পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ, সংবেদনশীল/ সফিস্টিকেটেড ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, অপারেশন থিয়েটার প্রস্তুতকরণ, আলাদাকরনের পর বাচ্চাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা সমস্ত কিছুই মিলিটারি অপারেশন এর মত সম্পন্ন হয়েছে।

আমাদের হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনে একটি কমান্ড সেন্টার স্থাপিত হয়েছিল সমস্ত কর্মকান্ড সমন্বয়ের জন্য। সমস্ত অপারেশনটি লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছিল প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয়তলায়, যেখানে বাংলাদেশের নিউরো ও প্লাস্টিক সার্জারি প্রশিক্ষনার্থীরা সমস্ত অপারেশন প্রত্যক্ষ করেছিল।

অপারেশন শেষ করার পর আমাদের শিশু নিউরোবিশেষজ্ঞরা দায়িত্ব বুঝে নেয় রিহ্যাব এর জন্য। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতাল সফল ভাবেই সামলে এসেছে। রাবেয়া-রোকেয়া এবং তাদের পিতা-মাতা ভালো ভাবেই তাদের মনোবল ধরে রেখেছেন। আর কটা দিন গেলেই অপারেশনের ০১ বৎসর পূর্ণ হবে। করোনা কালীন সময়ে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের সবাইকে করোনা মুক্ত রাখা। এখনো তারা সুস্থ আছে। সবাই এই শিশুদের জন্য প্রার্থনা করি!

নিচের লিংকে রাবেয়া- রোকেয়া কে নিয়ে করা একটি টিভি প্রতিবেদন-

Sarif Sahriar:
Related Post